বিচার ও সংস্কার কি নির্বাচনের প্রতিপক্ষ?

অদিতি করিম
  ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১৩:১০

এবার ঈদের ছুটি কেটেছে অনেকটা নিরাপদ ও স্বস্তিতে। ঈদ যাত্রায় মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। আবার ঈদের ছুটি দীর্ঘ হওয়ায় পরিবার-পরিজনের সঙ্গে চমৎকার মিলনমেলার সুযোগ হয়েছিল। ঈদ-কেনাকাটায় এবার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য লক্ষ্য করা যায়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছিল। ঈদের সময়টায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ছিল নিয়ন্ত্রণে। ঈদের কিছুদিন আগে যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে আমাদের সময় কাটছিল, সব কিছু মিলিয়ে ঈদ ঘিরে সেখান থেকে একটা স্বস্তি ও আস্থার জায়গায় ফিরেছি আমরা। কিন্তু এই স্বস্তি ও আস্থার পরও নতুন করে জনমনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে।
মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন উদ্বেগ। আগামী দিনের রাজনীতি কোন পথে? নির্বাচন ও সংস্কার করতে গিয়ে কি রাজনীতি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়বে? নির্বাচন, গণহত্যার বিচার ও রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নে কি দেশে নতুন করে সৃষ্টি হবে অশান্তি?
বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। তারা মনে করছে, ন্যূনতম সংস্কারগুলো করে অবিলম্বে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো বিকল্প নেই।
অন্যদিকে তরুণ সমাজ মনে করছে, রাষ্ট্র সংস্কার এবং বিচারের আগে নির্বাচন করা উচিত নয়। এটি নিয়ে রোজার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে টানাপড়েন দেখা গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, ঈদের পর রাজনীতিতে এই টানাপড়েন কি বড় ধরনের বিরোধে রূপ নেবে? আর সেই বিরোধের পরিণতিই বা কী হবে?
৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ আট মাস শেষ হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে এখনো পর্যন্ত নির্বাচনের সুস্পষ্ট কোনো রূপরেখা পাওয়া যায়নি। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে মোটা দাগে নির্বাচনের একটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা বলেছেন বারবার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে কি গণহত্যার বিচার এবং রাষ্ট্র সংস্কার করা সম্ভব হবে?
জবাব হচ্ছে, না। কারণ গণহত্যার বিচার ও রাষ্ট্র সংস্কার দুটিই দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। আগামী বছরের জুনের মধ্যে এটা শেষ করা বেশ দুরূহ। যারা জুলাই-আগস্ট গণহত্যার সঙ্গে জড়িত, তাদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিচার প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান রয়েছে। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান আমাদের সামনে একটি বাস্তবতা হাজির করেছে, একটি সত্যকে স্পষ্ট করেছে। তা হলো, বাংলাদেশের যে রাষ্ট্রকাঠামো, তার পরিবর্তন হওয়া দরকার। কারণ এই রাষ্ট্রকাঠামোই কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিল। এ অবস্থার অবসানে প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রবির্নিমাণ। এই রাষ্ট্র সংস্কার শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনায় নয়, সংবিধান, বিচার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ সব ক্ষেত্রে সংস্কার এখন সময়ের দাবি। কিন্তু এই রাষ্ট্র সংস্কার কিভাবে হবে, কত দিনে কতটুকু হবে? এটি একটি বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্ন প্রতিদিন রাজনৈতিক অঙ্গনকে দ্বিধাবিভক্ত করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি সবার আগে নির্বাচন হয়, তাহলে কি রাষ্ট্র সংস্কার এবং বিচার ব্যাহত হবে? এই প্রশ্ন ঘিরেই রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
নির্মোহভাবে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব জুলাই গণহত্যাকারী, দুর্নীতিবাজ, লুণ্ঠনকারীদের বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার এবং নির্বাচন তিনটি পৃথক বিষয়। একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, নির্বাচন যদি আগে হয়ে যায় তাহলে বিচার ও সংস্কার বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ রকম আশঙ্কার কিছু কারণও রয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের যে নতুন রাষ্ট্রকাঠামো বিন্যাসের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, সেটি আমরা করতে পারিনি। একাত্তরের ঘাতকদের বিচার যথাসময়ে হয়নি। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর তিন জোটের যে রূপরেখা প্রণীত হয়েছিল, তা বাস্তবায়িত হয়নি। এসব ব্যর্থতার কারণে অনেকেই এবার সতর্ক।
ফলে যারা আগে বিচার ও রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি উত্থাপন করছে, তাদের পক্ষে মূল যুক্তি হচ্ছে—নির্বাচন হয়ে গেলে বিচার প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্র সংস্কার বাধাগ্রস্ত হতে পারে। যাঁরা নির্বাচিত হবেন, তাঁরা গণহত্যাকারীদের সঙ্গে রাজনৈতিক দরকষাকষির মাধ্যমে সমঝোতা করতে পারেন। এ রকম আশঙ্কা থেকেই জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ তরুণদের একটি বড় অংশ মনে করছে, সবার আগে রাষ্ট্র সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা নাহিদ ইসলাম ঈদের দিনও বলেছেন, ‘গণহত্যার বিচার এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার আগে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’ তিনি এটিও মনে করেন, গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করা উচিত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিচারের সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্কের বাস্তবতা কতটুকু?
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানকে সামনে রেখে বর্তমান সময়কে যদি আমরা মিলিয়ে দেখি তাহলে দেখব, নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের পর মাত্র তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নব্বইয়ের ডিসেম্বরে দায়িত্ব গ্রহণ করে একানব্বইয়ের ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল বিএনপি। নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হওয়ার পর কিন্তু এরশাদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি; বরং এরশাদ একাধিক মামলায় দণ্ডিত হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন কারাবরণ করতে হয়েছিল সাবেক এই সেনাপ্রধানকে। কাজেই নির্বাচন হলেই যে অপরাধীদের বিচার হবে না, এই যুক্তির কোনো ভিত্তি নেই।
নব্বইয়ের চেয়ে জুলাই আন্দোলনের আবেগ এবং মাত্রা অনেক বিস্তৃত। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ছিল একটি সর্বাত্মক গণ-আন্দোলন। কাজেই জুলাই আন্দোলনের পর যারা গণহত্যাকারী, যারা ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্র লুণ্ঠন করেছে, তাদের বিচার না করা হবে সামাজিক ও রাজনৈতিক অপরাধ। আমার মনে হয় না কেউ বিচার না করার পক্ষে অবস্থান নেবে এবং বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে। এ ধরনের উদ্যোগ নিলে তরুণসমাজ দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আবারও তাদের প্রতিহত করবে। কাজেই বিচার কখনো নির্বাচনের পথে বাধা হতে পারে না; বরং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার বিচার প্রক্রিয়াকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আরো গ্রহণযোগ্যতা দিতে পারবে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে নির্বাচিত সরকারকে এই বিচারের রায় কার্যকর করতে কোনো ধরনের চাপ বা ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হবে না।
এখন দেখা যাক, রাষ্ট্র সংস্কারের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো বিরোধ রয়েছে কি না। রাষ্ট্র সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। রাষ্ট্র সংস্কার একটি বিমূর্ত ধারণা। একটি রাষ্ট্রে আজকে যেটি বাস্তবতা, আগামী দিনে তা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যেতে পারে।
রাষ্ট্র সংস্কারের অন্যতম বিষয় সরকার পদ্ধতির বিষয়টি যদি পর্যালোচনা করি তাহলে আমরা দেখব, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র। বাহাত্তরের সংবিধানে সংসদীয় ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র বাতিল করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। অর্থাৎ রাষ্ট্র কাঠামোর একটি মৌলিক পরিবর্তন করা হয়।
জিয়াউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণ করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করেন। তিনি আর সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাননি। তখনকার বাস্তবতায় মনে হয়েছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা ভালো। কারণ তখন একজন নেতার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পুনর্গঠন এবং উন্নয়নের প্রয়োজন ছিল। কাজেই সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থার পরিবর্তে তিনি বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থার প্রচলন করেন। তখনকার বাস্তবতায় এটি ছিল সময়ের দাবি।

রাষ্ট্র সংস্কার চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণকে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি, চিন্তা-ভাবনার কথাগুলো বলতে হবে। জনগণ যে চিন্তা ও মতামতকে গ্রহণ করবে, সেই দলকে নির্বাচিত করবে। নির্বাচিত ওই দল রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব নেবে। বিজয়ী দল তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার এবং কর্মসূচি অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার করবে।


আবার গত শতাব্দীর ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি যৌথ নেতৃত্ব কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়। তিন জোট যুগপত্ভাবে আন্দোলন করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। এখানে একটি যৌথ নেতৃত্বের ধারণা এবং বহুমতের বহু চিন্তার আলোকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার গণতন্ত্রের ধারণা জনপ্রিয়তা পায়।
কাজেই নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে বিজয়ের পর একানব্বই সালে বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত গণতান্ত্রিক সরকার আর রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় থাকেনি। তারা সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে তাদের মতামত দেয়। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় উত্তরণ করে। সরকার কাঠামোয় এটি ছিল একটি বড় ধরনের সংস্কার। সেই সংস্কারের আলোকে বাংলাদেশে এখনো সংসদীয় গণতন্ত্র চলছে। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারায় চলতে গিয়ে আমরা দেখছি, এখানে ক্ষমতার ভারসাম্য এবং জবাবদিহিতা অনুপস্থিত। প্রধানমন্ত্রীর হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমান সংবিধান সংসদীয় গণতন্ত্রের বদলে প্রধানমন্ত্রী শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। একজন প্রধানমন্ত্রী যতবার ইচ্ছা সরকারপ্রধান হিসেবে থাকতে পারেন। এতে তাঁর স্বৈরাচারী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমনকি রাষ্ট্রপতিকে নামমাত্র একটি আলংকারিক পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ক্ষমতার ভারসাম্য সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। মূলত ১৯৯১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমরা এর খারাপ দিক এবং ক্রটি-বিচ্যুতিগুলো আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি। এর পরিবর্তন সময়ে দাবি।
জনগণ এখন জানে, একটি ভারসাম্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কী কী দরকার। কোথায় কোথায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা দরকার। রাষ্ট্রের এ রকম বহু ক্ষেত্রেই সংস্কারের কাজ করছে এই সরকার। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত করে সংস্কারের দাবি নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। সবাই মনে করেন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে জনগণের করতে হলে এর ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো দূর করতে হবে। সেটিই সংস্কার।
কিন্তু সংস্কার কোনো ‘সোনার পাথরবাটি’ নয় বা সংস্কার স্থায়ী কোনো বিষয় নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা, প্রয়োজনীয়ও পরিবর্তিত হয়। সংস্কার আসলে একটি চলমান প্রক্রিয়া। গত সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের মধ্য দিয়ে আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এখন রাষ্ট্রকে ঢেলে সাজানোর জন্য যে পরিবর্তন এবং সংযোজন-বিয়োজন করা দরকার, সেটিই হলো আসল রাষ্ট্র সংস্কার।
কিন্তু রাষ্ট্র সংস্কারের পদ্ধতি ও ধরন নিয়ে সবাই একমত হবেন—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ প্রত্যেক রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে রাষ্ট্র সংস্কারের চিন্তা করে। বিএনপির নিজস্ব গঠণতন্ত্র এবং কর্মসূচি রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির নিজস্ব গঠণতন্ত্র এবং কর্মসূচি রয়েছে। প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্রকে ঢেলে সাজাতে চায়। কাজেই বিএনপি যেভাবে রাষ্ট্র সংস্কারকে দেখে, ঠিক সেভাবে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা জামায়াত দেখে না। এটি গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য। আর এ কারণে রাষ্ট্র সংস্কারে জনগণের মতামত গুরুত্বপূর্ণ।
রাষ্ট্র সংস্কার চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণকে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি, চিন্তা-ভাবনার কথাগুলো বলতে হবে। জনগণ যে চিন্তা ও মতামতকে গ্রহণ করবে, সেই দলকে নির্বাচিত করবে। নির্বাচিত ওই দল রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব নেবে। বিজয়ী দল তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার এবং কর্মসূচি অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার করবে।
এ কারণেই আমি মনে করি, রাষ্ট্র সংস্কারের আগে একটি নির্বাচন দরকার। কারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে জনগণের মতামত বেরিয়ে আসবে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। এই অবস্থায় রাষ্ট্রের যে সংস্কার প্রয়োজন, তা কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু কতটুকু সংস্কার করতে হবে বা এই সংস্কার কিভাবে এগিয়ে নিতে হবে সে সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। জনগণ এই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে তখনই, যখন একটি নির্বাচন হবে। কাজেই আমার ধারণা বিচার ও সংস্কার কখনো নির্বাচনের প্রতিপক্ষ নয়; বরং একটি নির্বাচন বিচার প্রক্রিয়াকে যেমন ত্বরান্বিত করতে পারে, ঠিক তেমনি এগিয়ে নিতে পারে সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে। আর এই বিষয়টিকে একে অন্যের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হবে গণতন্ত্রের পথে এক অশনিসংকেত।
লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক
সূত্র: কালের কণ্ঠ