চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন পাহাড়ি জনপদ

হাতছানি দিচ্ছে পর্যটকদের
রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি
  ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৬

নানামুখী অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে দুর্গম পাহাড়ি জনপদকেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখন আর দুর্গম মনে হয় না। বিশেষ করে উঁচু-নিচু পাহাড়ের গা বেয়ে সরীসৃপের মতো নির্মিত শত শত কিলোমিটারের আঁকা-বাঁকা পিচঢালা মসৃণ পাহাড়ি সড়কগুলো সব অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। সড়কের পাশাপাশি বড় বড় ব্রিজ-কালভার্ট এক পাহাড়কে আরেক পাহাড়ের সঙ্গে যুক্ত করেছে। দুই-তিন দিনের গন্তব্যে এখন কয়েক ঘণ্টায় যাওয়া-আসা করা যায়। যা পাহাড়ি জনপদের মানুষগুলোর কাছে স্বপ্নের মতো। মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, দেখতে পিকআপের মতো যাত্রীবাহী চাঁদের গাড়ি, বাস, মাইক্রোবাস ও জিপ নিয়মিত চলাচল করে সড়কগুলোতে। পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হওয়ায় বাড়ছে পর্যটকের সংখ্যাও। 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি হিসেবে পরিচিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’র পর উন্নয়নের গতি বেড়ে যায়। ১৯৯৭ সালে চুক্তি সম্পাদনের পর পার্বত্যাঞ্চলকে দেশের মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য সরকার তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। বিগত ২৬ বছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প কারখানা, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পসহ অনেক খাতেই সরকার নানামুখী উন্নয়ন পদক্ষেপ নেয়।
স্থানীয়রা বলছেন, রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় এমন চোখ ধাঁধানো সড়ক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবে, স্বপ্নেও ভাবেননি তারা। সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির ফলে এখন আর তারা অনেক খুশি। চুক্তির কতটুকু কী হলো সেটা নিয়েও এখন আর তাদের জানার আগ্রহ নেই। তাদের চোখ উন্নয়নের দিকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার যত উন্নতি হবে, তত জীবন মান উন্নত হবে বলে মনে করেন তারা।
গত ২৬ নভেম্বর আসাম বস্তির নিকটবর্তী লাভ পয়েন্টের পাশে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী বিদুষী খিসার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, কখনও আশাই করিনি রাঙ্গামাটি থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উপজেলা পর্যায়ে গিয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারবো। স্থানীয় মগবান স্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মী কাকলি চাকমা বলেন, প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে তারা স্থানীয়দের স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে থাকেন। স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কে তাদের সচেতন করার কাজ করছেন। কীভাবে কী করলে তারা স্বাস্থ্য সেবা পাবেন। যুদ্ধরাম চাকমা বলেন, যে জায়গায় আগে নৌপথে যেতে দিন ফুরিয়ে যেত সেখানে এখন সড়ক পথে দুই-তিন ঘণ্টায় যাওয়া-আসা করা যায়। এমন উন্নত সড়ক ব্যবস্থা হবে তারা স্বপ্নেও ভাবেননি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের আওতায় নারী উন্নয়ন, আয়বর্ধক কর্মকাণ্ড, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকার ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে। পার্বত্য এলাকায় শিশু ও তাদের পরিবারের নিকট মৌলিক সামাজিক সেবাগুলোর প্রাপ্যতা বাড়াতে ৪ হাজার ৮০০ পাড়াকেন্দ্র নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। ১ লাখ ২০ হাজার শিশুকে প্রাক শৈশব স্তরে শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। ২ লাখ ৬ হাজার পরিবারের শিশু, কিশোরী ও মহিলাদের রক্তস্বল্পতা ও পুষ্টি ঘাটতি জনিত সমস্যা প্রতিরোধ করা হয়েছে। চারটি আবাসিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থীকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আয়বর্ধক কর্মসূচি হিসেবে উন্নত জাতের বাঁশ উৎপাদন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। অসচ্ছল ও প্রান্তিক পরিবারের নারী উন্নয়নে গাভী পালন প্রকল্প, সুগারক্রপ চাষাবাদ জোরদারকরণ প্রকল্প, কফি ও কাজুবাদাম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র হ্রাসকরণ প্রকল্প, তুলা চাষ বৃদ্ধি ও কৃষকদের দারিদ্র বিমোচন প্রকল্প, প্রত্যন্ত এলাকায় সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ, মিশ্র ফল চাষ, উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিকরণ প্রকল্পগুলো অন্যতম।

যোগাযোগে উন্নয়ন
রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে ১ হাজার ২১২ কিলোমিটার। কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে ৭০০ কিলোমিটার। যা পরবর্তীতে পাকা করার চিন্তাভাবনা রয়েছে সরকারের। বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সংস্কার করা হয়েছে ৬১৪ কিলোমিটার। ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে সর্বমোট ৯ হাজার ৮৩৯ মিটার। এরমধ্যে রাঙ্গামাটিতেই শুধু ৫ হাজার ৯২৮ মিটার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে ১৪১ মিটার। সরকারের সবচেয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হচ্ছে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সীমান্ত সড়ক নির্মাণ। যার দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার। তিনটি পেজে ২০২৫ সালের মধ্যে এ সহস্রাধিক কিলোমিটারের দুর্গম সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজ শেষ করার পরিকল্পনা সরকারের। একসময় যাকে অসম্ভব বলে মনে হতো সেটা এখন দৃশ্যমান। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ২০৫ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। শত শত ফিট গভীর ও উচ্চতায় নির্মিত হচ্ছে এ সীমান্ত সড়ক।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে উন্নয়ন
শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক খাতেও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছে সরকার। এরমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, সংস্কার, শিক্ষা বৃত্তি প্রদান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন এবং পানি সম্প্রসারণ কার্যক্রম, সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ, হাটবাজার উন্নয়ন ও বনায়ন কার্যক্রম রয়েছে। 
পার্বত্য চুক্তির আগে তিন পার্বত্য জেলায় উচ্চ বিদ্যালয় ছিল ১৯৬টি। চুক্তির পর বিগত ২৬ বছরে আরও ৪০৪টি বাড়ানো হয়েছে। কলেজ ছিল ২৫টি। বর্তমানে ৫১টি। তিন জেলায় তিনটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রাঙ্গামাটিতে একটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার রয়েছে। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে স্থাপিত ও পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৩টি। সর্বমোট ৫৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত সহায়তা দিয়ে থাকে সেনাবাহিনী। চুক্তির আগে মাত্র ৯১টি থাকলেও বর্তমানে ২১২টি হাসপাতাল রয়েছে। ছোট-বড় শিল্প কারখানা ছিল ১৭টি। বর্তমানে ৪৪টি। চুক্তির আগে ২ হাজার ২৬৬টি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প থাকলেও বর্তমানে ৭ হাজার ২৯৯টি। মসজিদ, মন্দির, কিয়াং ও গির্জা স্থাপনে ব্যাপক সহযোগিতা করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। 

অন্যান্য খাতে উন্নয়ন
রাঙ্গামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, শিশু পার্ক, বাস টার্মিনাল, ঈদগাহ, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, বাঁধ, স্টেডিয়াম নির্মাণ, ফুড বেকারি, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পর্যটন কেন্দ্র, সোলার প্যানেল বিতরণসহ পার্বত্যাঞ্চলে নানামুখী অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলমান রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সাবেক কূটনীতিক সুপ্রদীপ চাকমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরকার দিতে চায়। অথচ নানা কারণে আমরা নিতে পারছি না। আমাদের নেওয়ার যোগ্যতা নেই। সীমান্ত সড়কসহ পাহাড়ের ঢালে ঢালে যে সড়ক উন্নয়ন হয়েছে, অন্যান্য খাতে যে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে, এ অঞ্চলের মানুষ কখনই তা ভাবেনি।