রাতের জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ 

উম্মে তাসবীহ
  ১৩ মার্চ ২০২৪, ১২:৩৯

এই পর্যন্ত যতবার নিউ ইয়র্ক গিয়েছি, বেশিরভাগ সময় যাওয়া হয়েছে রাতের দিকে। এই হয়তো কারো অলঙ্কার, কাগজপত্র অথবা জরুরী অন্য কিছু  পৌঁছে দিতে বা কাউকে আনা-নেয়া করতে। প্রথমবার গিয়েছিলাম ট্রেনে। সে এক অন্য অভিজ্ঞতা তবে সড়ক পথে প্রথমবার যাওয়ার অভিজ্ঞতা বলি।
এক সময় খুব পোস্টার লাগানোর চল ছিল ঘরে ঘরে। আমরা ভিউ কার্ড, পোস্টারের আমল না দেখলেও আমাদের বাবা-মা, খালা-ফুপু এরকম বহু মানুষের জমানো স্মৃতির ভাণ্ডারের মাধ্যমে জেনেছি যে এককালে এইসবের কেমন কদর ছিল। আমিও এখন ঘরে পোস্টার লাগাই। অনেকেই ফ্রেম করার কথা বলেন তবে আমার মনে হয় পোস্টারের এক আলাদা আবেদন আছে। আমার দাদার বাড়ির এক ঘরে জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ অথবা গোল্ডেন গেট ব্রিজের বিশাল এক পোস্টার লাগানো ছিল। এখন আর স্পষ্ট করে মনে নেই ঠিক কোন ব্রিজ ছিল সেটা।
ছোটবেলায় যখনই দাদাবাড়ি যেতাম, সেই পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। মনে হতো, এটাই তাহলে আমেরিকা! আমি আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা বলছি যখন সোশ্যাল মিডিয়া, ইউ টিউব তো দূরের কথা সবার ঘরে ডিশের লাইনও ছিল না। গ্রামে বেশিরভাগ বাড়িতে ছিল না টেলিভিশন। কাজেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে তখন শহর মানে ঢাকা আর বিদেশ মানে মূলত আমেরিকা। সেই  সময় আমেরিকার যে ক্রেইজ ছিল এখনকার সময়ে এসে সেটা কল্পনাও করা যায় না। আমরা একটু একটু আমেরিকা দেখতাম ‘ম্যাকগাইভার’ যখন আবার নতুন করে প্রচার শুরু হলো একুশে টিভিতে আর দেখতাম বিটিভির মুভি অব দ্যা উইকে। তাই যখন সেই ব্রিজের পোস্টারের সামনে দাঁড়াতাম, রোদ ঝলমলে নদী আর নীল আকাশের মাঝে দাঁড়ানো ব্রিজটাকে মনে হতো কি বিশাল! রোদের রঙটাও যেন আমাদের দেশের রোদের চেয়ে আলাদা। আমেরিকা মানে তখন সেই ব্রিজ আর আমার আম্মার খালাতো ভাই, শাহীন মামার এক ছবি, যে ছবিতে তিনি লেকের ধারে লাল লাল পাতাভরা এক গাছের নিচে শুকনো পাতার উপর লাল সোয়েটার পরে এক হাঁটু  মুড়ে বসে আছেন, পেছনে লাল বনভূমি। ভাবতাম, বিদেশের অনেক বন বুঝি এমনই লাল। ফল কাকে বলে জানতাম না। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এখনও অনেক মানুষ অনেক দৃষ্টিনন্দন জায়গায় ছবি তুলে আপলোড করেন, ছবি দেখলে বোঝা যায় দেশের বাইরে কোথাও তোলা কিন্তু সেই সময়কার ছবিগুলোর যে রেট্রো ভাইব, বিদেশ ধারণার অসহজলভ্যতা, সব মিলিয়ে এখনো আমার কাছে মনে হয় সেই ছবিটাই আমেরিকা।
যেদিন প্রথম সড়ক পথে নিউ ইয়র্ক গেলাম, নিউ জার্সি ছাড়িয়ে ম্যানহাটন ঢুকতে এই জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ পেলাম। হাডসন নদীর উপর সেই ব্রিজ। আমার ছোটবেলার সেই ব্রিজ! কেমন লাগা উচিৎ ছিল এখন ভাবি।
নিউ জার্সির বারগেন কাউন্টির ফোর্ট লী আর ম্যানহাটনের ওয়াশিংটন হাইটস যুক্ত হয়েছে এই সেতুর মাধ্যমে। এবং আমরা দেশে এই মার্জিনে এই ব্যাপকতার কোনো সেতুর সাথে পরিচিত না বলেই জানি। কিন্তু আমার মনে চট করে এলো, বিদায় ঢাকা জেলা-স্বাগতম গাজীপুর জেলা! ছোট্ট তুরাগ সেতুর নিচ দিয়ে যেখানে বয়ে চলেছে তুরাগ নদী। যে পথ দিয়ে একসময় ঢাকা থেকে আমার শহরে যেতাম। আর ব্রিজটা পার হতে হতে যেন হাজার হাজার তারায় খচিত আলোকিত নিউ ইয়র্ক দেখে আমার মনে পড়ল রাতের বেলা বাবুবাজার ব্রিজ পার হতে হতে যেমন দেখতাম বুড়িগঙ্গার পাড়ের আলোকিত জমজমাট সদাব্যস্ত ঢল। ওই পাড়ের কেরানীগঞ্জ।
এরপর যত ফ্লাইওভারে উঠলাম আর আন্ডারপাস দিয়ে গেলাম, মনে হতে লাগলো কোনোটা মহাখালি, কোনোটা এয়ারপোর্ট রোড। ফ্লাইওভারের পাশের বহুতল ভবন দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল আশালতা, স্বর্ণলতা ভবনগুলির কথা। ছোট ছোট আরও কিছু ব্রিজ আর আলোকসজ্জা দেখে মনে হলো হাতিরঝিল।
আসলে নিউ ইয়র্ক তো অনেক পুরনো শহর। সে তার জন্মলগ্ন থেকে এইরকম আধুনিক। অনেক পুরনো ভিডিও বা ইংরেজি সিনেমাগুলো দেখলেও বোঝা যাবে যে আজকের রাস্তাঘাট, উঁচু উঁচু ভবনগুলি, ক্যাফে রেস্তোরাঁ, মিউজিয়াম প্রায় সত্তুর আশি বছর আগেও অনেকটা এমনই ছিল। কিন্তু আমরা বিগত দুই তিন দশক ধরে ধীরে ধীরে অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধার দিক দিয়ে এগিয়ে এসেছি। এত বড় স্কেলে দেখিনি কিন্তু ছোট স্কেলে হলেও আজকের মানুষ এই সব রকম ধারণার সাথে পরিচিত। তার সাথে যোগ হয়েছে অন্তরজাল। আমাদের এখন বিস্মিত করা অনেক কঠিন। ছোটবেলার অনেক কিছুর সাথে ছোটবেলার বিস্ময়ও হারিয়ে গেছে কবেই।
নিউ ইয়র্কে এলে, কোনো বাংলাদেশী খাবারের দোকানে বসলে বরং বাংলাদেশের কথা আরও বেশি মনে পড়ে। এখন শীতকালে এই শহরের অনেক শ্রমজীবী মানুষ, যাদের চেহারায় এখনও দেশের পরিশ্রমী মানুষের ছাপ, ভারী শীতের পোশাক পরে এসে যখন একত্রিত হয়ে চায়ের আড্ডায় বসেন, তখন আমার সেইসব টঙ দোকানের কথাই মনে পড়ে, দেশের শীতে জবুথবু মাফলার প্যাঁচানো সোয়েটার পরা শ্রমজীবী মানুষেরা যেভাবে উষ্ণতা তাপান। এখানেও লেখা থাকে, পলিটিক্যাল ডিসকাশন প্রোহিবিটেড।
শুধু এখনও সমান বিস্মিত হই প্রকৃতি দেখে। রোদের রঙটা যেন আলাদাই। বাতাসটা হালকা। প্রকৃতিও এখানে কোথাও কোথাও অনেক বড় জ্যামিতিক চিহ্ন হয়ে আছে আমরা যা দেখে এসেছি তার চেয়ে, তবু সে যেখানেই থাকুক, সে তো সমান সুন্দরী।