ঢাকার নিম্নআদালতে বিচারাধীন রাজনৈতিক মামলাগুলোর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে থাকা ১২৪টি মামলার বিচারে গতি এসেছে। প্রসিকিউশন বিভাগ এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে। এতদিন এসব মামলার বিচার এক রকম গতিহীন ছিল।
গত ১১ ডিসেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (প্রসিকিউশন বিভাগ) কার্যালয় একটি অফিস আদেশ জারি করে। সেখানে রাজধানীর ৩০টি থানার ১২৪টি মামলার তালিকা দিয়ে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি সাবকমিটি গঠন করা হয়েছে।
ওই অফিস আদেশে বলা হয়েছে, ‘বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন রাজনৈতিক মামলার বিচারকাজ ত্বরান্বিত করার জন্য নিম্নলিখিত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি সাবকমিটি গঠন করা হলো। গঠিত কমিটির সদস্যরা দায়িত্বাধীন ছক মোতাবেক সংশ্লিষ্ট আদালত কর্তৃক মামলার নিয়মিত কার্যক্রম যথা- সমন ইস্যু ও জারি, সাক্ষী হাজির, সাক্ষীদের ডকেট ব্রিফকরণ, পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ও অ্যাসিসট্যান্ট পাবলিক প্রসিকিউটরদের (এপিপি) সঙ্গে সমন্বয় করা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু ও তামিল, আলামত ব্যবস্থাপনা ও কোর্টে যথাসময়ে উপস্থাপন ও বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক ধার্য তারিখসমূহের আদেশ বাস্তবায়নকরত গৃহীত পদক্ষেপ নিয়মিতভাবে উপপুলিশ কমিশনার (প্রসিকিউশন বিভাগ) মো. জসিমউদ্দিনকে অবগত করতে হবে।’
আদেশে আরও বলা হয়েছে, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে উল্লিখিত মামলাসমূহের সংশ্লিষ্ট আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ধার্য তারিখের দুই দিন পূর্বে প্রসিকিউশন বিভাগে সাক্ষীদের উপস্থিত করবেন। এরপর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সম্পূর্ণরূপে ব্রিফ প্রদান করে ধার্য তারিখে সাক্ষ্যপ্রমাণের নিমিত্তে আদালতে হাজির করবেন। উপস্থিত সাক্ষীদের আবাসস্থল ও নিরাপত্তাসহ সব ব্যবস্থা ইনচার্জ, সিএমএম কোর্ট হাজতখানা নেবেন।’
সাবকমিটিতে ছয় জন অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনারকে তদারকি কর্মকর্তা এবং ১১ পুলিশ ইন্সপেক্টর ও ১৯ জন সাব-ইন্সপেক্টরকে (এসআই) আদেশ বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে।
মামলার তালিকায় দেখা যায়, ৩০টি থানার মামলার মধ্যে সর্বাধিক ১৮টি মামলা রাজধানীর পল্টন থানার। বাকিগুলোর মধ্যে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার ১২টি, কোতোয়ালি থানার ১১টি, শাহবাগ থানার ৯টি, মুগদা থানার ৮টি, রমনা ও বংশাল থানার ৭টি করে, খিলগাঁও থানার ৬টি, বাড্ডা থানার ৫টি, উত্তরা পশ্চিম, সবুজবাগ ও মিরপুর থানার ৪টি করে, মতিঝিল ও ভাটারা থানার ৩টি করে, ডেমরা, উত্তরা পূর্ব, শাহআলী, লালবাগ, আদাবর, কাফরুল ও খিলক্ষেত থানার ২টি করে এবং শাহজাহানপুর, গুলশান, কদমতলী, রূপনগর, বনানী, শেরেবাংলা, দক্ষিণখান, মোহাম্মাদপুর ও পল্লবী থানার একটি করে মামলা রয়েছে।
মামলারগুলোর অধিকাংশই ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারাধীন। কিছু মামলা বিচারাধীন ঢাকা মহানগর জজ আদালতের অধীনস্থ বিভিন্ন আদালত ও সাইবার ট্রাইব্যুনালে। মামলাগুলো ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দায়ের হওয়া। মামলাগুলোর অধিকাংশই সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। কিছু মামলা চার্জগঠনের পর্যায়ে রয়েছে।
জানা গেছে, মামলাগুলোয় আসামির তালিকায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, আমানউল্লাহ আমান, রুহুল কবির রিজভী, বরকতউল্লাহ বুলু, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আবদুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, শওকত মাহমুদ, শামছুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, হাবিব-উন নবী খান সোহেল, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, রাজিব আহসান, ইসহাক সরকার, জয়নুল আবেদীন ফারুক, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, নাজিমউদ্দিন আলম, ফজলুল হক মিলন, নবীউল্লাহ নবী, মীর শরফত আলী, নাদিম মোস্তফা, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, আজিজুল বারী হেলাল, শিরিন সুলতানা, শফিউল বারি, আসিফা আশরাফী পাপিয়া, তৈমূর আলম খন্দকার, আবদুল কাদের ভুঁঁইয়া (জুয়েল) ও হাবিবুর রশীদসহ এক হাজারেরও বেশি বিএনপি নেতাকর্মীর নাম রয়েছে। মামলাগুলোয় জামায়াতে ইসলামীর কিছু নেতাকর্মীকেও আসামি করা হয়েছে।
রাজনৈতিক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির তালিকার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ‘তালিকা সম্পর্কে আমার জানা নেই। আমি কোনো তালিকা পাইনি।’
এ বিষয়ে উপপুলিশ কমিশনার (প্রসিকিউশন বিভাগ) মো. জসিমউদ্দিনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিএনপিদলীয় আইনজীবী ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এ মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীকে এসব মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে সরকার একতরফা আরেকটি নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসার পাঁয়তারা করছে।
১৯৯১ সালের পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলই একটানা দুই কিংবা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল না। ফলে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পরই বিগত সরকারের সময়ে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব রাজনৈতিক মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার একটানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহার হয়নি।
২০০৯-১৩ মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় ৭ হাজার ১৯৮টি মামলা সম্পূর্ণ বা আংশিক প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছিল। এর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ছিল হত্যা মামলা। ইতিমধ্যে এসব মামলার বেশির ভাগই প্রত্যাহার হয়েছে। ওই সময় আলোচিত কিছু মামলাও রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়। এর পরের মেয়াদে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনায় ৩৪টি হত্যা মামলাসহ ২০৬টি আলোচিত মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এর আগে ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও হরতাল-অবরোধে নাশকতায় ৫ হাজার ৮৮৮টি মামলা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং ৯৪৫টি মামলা থেকে কিছু আসামিকে অব্যাহতি দেয়। ওই সব মামলা প্রত্যাহারে মোট ৭৩ হাজার ৫৪১ জন আসামি বিচার এড়াতে সক্ষম হয়।
এদিকে হরতাল-অবরোধে নাশকতার ঘটনায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, মামলায় চার্জশিটও হয়। তবে বিচার হয় না। বিগত ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে বিএনপি সরকার এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নাশকতার অভিযোগে কয়েক হাজার মামলা হলেও একটিরও বিচার শেষ হয়নি। তবে বর্তমান সরকারের সময়ে ঢাকার নিম্নআদালতে ৩টি রাজনৈতিক মামলা রায় হয়েছে। যার মধ্যে একটি মামলায় বিএনপির ১০ কর্মীর ৫ বছর করে সশ্রম কারাদ- দিয়েছেন আদালত। এরপর গত ৮ মার্চ ৯ বছর আগের নাশকতার মামলায় বিএনপি ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জাহাঙ্গীর মোল্লাসহ চারজনকে দুই বছর করে কারাদ- দেন আদালত।