মেট্রোরেল উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী

দেশের উন্নয়ন ও অহঙ্কারের মুকুটে আরেক পালক

নিজস্ব সংবাদদাতা
  ২৯ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯:৩৮

দেশের প্রথম মেট্রোরেল চালুর মাধ্যমে দুর্বার গতিতে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল উত্তরার দিয়াবাড়ীতে মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় আরেকটি পালক দিতে পারলাম। ঢাকাবাসীকে দেশের অহংকারের মুকুটে আরেকটি পালক সংযোজিত করতে পারলাম।’ মেট্রোরেলের উদ্বোধনী মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন ও বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রওশন আরা মান্নান, ঢাকা-১৮ আসনের এমপি মোহাম্মদ হাবিব হাসান। বক্তৃৃতা করেন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি, জাইকার বাংলাদেশের প্রতিনিধি ইচিগুচি তমুহিদে, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) এমডি এমএএন সিদ্দিক। স্বাগত বক্তব্য দেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিনুল্লাহ নুরী।
সকালে দিয়াবাড়ী স্কুলের মাঠে সুধী সমাবেশে উপস্থিত হয়ে প্রথমে ফলক উন্মোচন করে মেট্রোরেলের উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। পরে সুধী সমাবেশে যোগ দিয়ে বক্তৃতা করেন তিনি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘হবে জয়’ কবিতার চরণ উদ্ধৃত করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘অসম সাহসে আমরা অসীম সম্ভাবনার পথে ছুটিয়া চলেছি, সময় কোথায় পিছে চাব কোন মতে! এগিয়ে যাব আমরা দুর্বার গতিতে, এগিয়ে যাবে বাঙালি দুর্বার গতিতে। গড়ে তুলব সকল বাধা অতিক্রম করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলব।’


২০১৬ সালের ২৬ জুন এমআরটি-৬ প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ে উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১.১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ চলছে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার সহযোগিতায়। উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এই লাইনের নাম দেওয়া হয়েছে এমআরটি-৬। প্রধানমন্ত্রী জানান, উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল হলেও শুরুতে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ৯টি স্টেশন চলাচলের জন্য খুলে দিয়েছে সরকার। নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে বৃহস্পতিবার থেকে মেট্রোরেলে চড়তে পারবেন সাধারণ মানুষ। এতে সড়কে দীর্ঘ যানজটের ভোগান্তি কাটিয়ে খুব অল্প সময়েই এই রুটে চলাচলের দুয়ার খুলছে ঢাকাবাসীর।
জনগণকে নিয়ম মেনে পরিচ্ছন্নভাবে মেট্রোরেল ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা অনুরোধ থাকবে, অনেক টাকা খরচ করে এই মেট্রোরেল করা হয়েছে। এটাকে সংরক্ষণ করা, এটার মান নিশ্চিত রাখা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, এই সবকিছু কিন্তু যারা ব্যবহার করবেন তাদের দায়িত্ব। এখানে অনেক আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে, ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার হয়েছে। এই সমস্ত জিনিস যেন নষ্ট না হয়। ব্যবহারের ক্ষেত্রে সকলে যত্নবান হবেন। খেয়াল রাখবেন, কেউ যেন আমাদের রেলস্টেশনগুলোতে আবর্জনা-ময়লা না ফেলে, অপরিচ্ছন্ন করতে না পারে। সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।’
মেট্রোরেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামালায় নিহত জাপানি নাগরিকদের স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের ওই ঘটনার পর মেট্রোরেলের কাজ পুনরায় চালু করার পেছনে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ভূমিকার কথাও স্মরণ করেন শেখ হাসিনা। নিহত জাপানি নাগরিকদের স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মাণের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাদের স্মৃতি যেন স্মরণে থাকে, আমরা সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
ঢাকার মেট্র্রোরেল নির্মাণকাজের উদ্বোধনের কিছুদিন পর ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় দুই নারীসহ সাত জাপানি নাগরিক নিহত হন। ওই হামলায় মোট ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল জঙ্গিরা। নিহত জাপানি নাগরিকের মধ্যে ছয় জন ছিলেন মেট্রোরেল প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল প্রকল্প পর্যন্ত এমআরটি-১ এবং নারায়ণগঞ্জের ভুলতা থেকে বাড্ডা, মিরপুর গাবতলী, ধানমন্ডি, বসুন্ধরা সিটি (পান্থপথ) হয়ে হাতিরঝিল লিংক রোড পর্যন্ত এমআরটি-৫ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাছাইয়ের কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন তারা। ওই হামলার পর জাইকা ও ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূতসহ বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করা বেশির ভাগ জাপানি তাদের দেশে ফিরে যান। পরে বাংলাদেশের তরফ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে সেপ্টেম্বরে আবার এই জাপানিদের ফিরিয়ে আনা হয়। চলতি বছরের জুলাইয়ে দিয়াবাড়ীর মেট্রোরেল ডিপোতে ওই নিহত জাপানের নাগরিকদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে সরকার। তাদের নির্মম প্রাণক্ষয়ের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি ও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শেষ হলে তাকে পুরো মেট্রোরেলের অবয়ব ‘স্যুভেনির’ তুলে দেন মেট্রোরেলের সঙ্গে সম্পৃক্তরা। পরে মেট্রোরেলের উদ্বোধন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকিটের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমনন্ত্রী। এ সময় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ও সচিব খলিলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া একই উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত পঞ্চাশ টাকা মূল্যমানের একটি স্মারক নোট অবমুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণের পর উদ্বোধনী মঞ্চের অদূরেই টিকিট কেটে মেট্রোরেলের যাত্রী হন। এর আগে তিনি অবতীর্ণ হন গার্ডের ভূমিকায়। সবুজ পাতাকা নেড়ে মেট্রোরেল চলাচলের সবুজ সংকেত দেন। তার পর সেই পতাকায় স্বাক্ষরও করেন সরকারপ্রধান। পরে বোন শেখ রেহানাসহ অন্য সঙ্গী যাত্রীদের নিয়ে মেট্রোরেলে চড়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পৌঁছান তিনি।
এদিকে মেট্রোরেলের উদ্বোধনী পর্ব বেলা ১১টার দিকে হলেও সকাল ৭টা থেকেই এদিন দিয়াবাড়ীর সমাবেশস্থলে ছিল উৎসুক জনতার ভিড়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোক সমাগম আরও বাড়তে থাকে। পার্শ্ববর্র্তী এলাকা থেকে দল বেঁধে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ব্যানার পোস্টার নিয়ে সমাবেশস্থলে আসতে থাকেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। নারীদের জন্য ছিল বিশেষ জায়গা এবং প্রবেশ ও বাইরের জন্য বিশেষ পথ। একপর্যায়ে নারীদের জন্য রাখা জায়গাও কানায় কানায় ভরে যায়।
এর আগে উদ্বোধনী মঞ্চের অদূরে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে সুইচ টিপে মেট্রোরেলের প্রতিকৃতি উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। এ সময় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সড়ক পরিবন ও সেতু মন্ত্রাণালয় সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি রওশন আরা মান্নান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, স্থানীয় এমপি মোহাম্মদ হাবিব হাসান উপস্থিত ছিলেন।