নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ২০২৪ সালের সেরা ১০ ব্যক্তিত্বের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে প্রখ্যাত সাময়িকী নেচার। বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদের নিয়ে প্রতি বছর এই তালিকা প্রকাশ করা হয়। গত সোমবার (৯ ডিসেম্বর) ড. ইউনূসকে নিয়ে একটি বিশদ নিবন্ধ প্রকাশ করেছে খ্যাতনামা এই সাময়িকী।
নেচার লিখেছে, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া প্রাণঘাতী বিক্ষোভে কর্তৃত্ববাদী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বিপ্লবী ছাত্রসমাজের একমাত্র দাবি ছিল, ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তী নেতা হিসেবে নিয়ে আসা।
পরিচিত লোকেরা বলছেন, এটি ইউনূসের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ছয় দশকের কর্মজীবনে তিনি দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য নতুন ধারণা পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সিস্টেম বুঝে সমস্যার সমাধান করা তার কাজের মূল ভিত্তি।
ড. ইউনূসের সঙ্গে ৩০ বছরের বেশি সময় কাজ করেছেন অ্যালেক্স কাউন্টস। তার কথায়, বয়স আশির কোঠায় হলেও তার (ড. ইউনূস) শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য দারুণ। তার সহানুভূতি রয়েছে এবং তিনি একজন চমৎকার যোগাযোগকারী।
‘বৈপ্লবিক অর্থনীতিবিদ থেকে অপ্রত্যাশিত নেতা’
১৯৪০-এর দশকে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ড. ইউনূস। ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং পরিবেশগত অর্থনীতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নিকোলাস জর্জেসকু-রোগেনের অধীনে পড়াশোনা করেন। সে সময়ই তার মধ্যে অর্থনীতি ও প্রকৃতির মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে স্পষ্ট বোঝাপড়ার সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং নতুন রাষ্ট্র গঠনে অংশ নেন।
১৯৭০-এর দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থাকা অবস্থায় তিনি ক্ষুদ্রঋণের ধারণা পরীক্ষা করেন। স্বল্প পরিমাণ ঋণ নারীদের মধ্যে বিতরণ করে তিনি দেখান যে, এটি দরিদ্রদের জীবনমান উন্নয়নে কতটা কার্যকর হতে পারে।
১৯৮৩ সালে তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক এখন বাংলাদেশজুড়ে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইউনূসের এই মডেল বিশ্বব্যাপী অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। যদিও কেউ কেউ এর সমালোচনা করে থাকেন।
দেশ পরিচালনার চ্যালেঞ্জ
গ্রামীণ ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান এবং ১৭ কোটি মানুষের দেশ শাসনের মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। বিক্ষোভকারী ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী, দুর্নীতি নির্মূল, নাগরিক অধিকার সুরক্ষা, কর্মসংস্থান ও শিক্ষায় সমতা এবং নিহতদের জন্য বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ মুশফিক মোবারক বলেন, আগস্ট বিপ্লবের আগে দেশের পুলিশ, নাগরিক সেবা, বিচারব্যবস্থাসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি ব্যাংকগুলোও শাসক দলের শাখা হয়ে উঠেছিল। এখন ইউনূস এবং ছাত্ররা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গ্রুপ তৈরি করেছেন যাতে যে দলই ক্ষমতায় থাক না কেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা পায়।
কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার খুব দ্রুত হতে পারে না। কুমিল্লার বাংলাদেশ একাডেমি অব রুরাল ডেভেলপমেন্টের (বার্ড) গবেষণা পরিচালক ফৌজিয়া সুলতানার মতে, এটি একটি জটিল ও ধীরগতির প্রক্রিয়া।
ছাত্রদের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ
অন্তর্বর্তী নেতা হিসেবে ড. ইউনূসের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে সেইসব ছাত্রের ওপর, যারা তাকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন। তারা একটি শক্তিশালী দল, যাদের ভূমিকা ২০১০-২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় স্বৈরশাসনবিরোধী সংগ্রামকারী যুবকদের মতো। সেই বিদ্রোহ সহিংসভাবে দমন করা হলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের গল্পটি ভিন্ন।
সেনাবাহিনী এবং ড. ইউনূস উভয়েই ছাত্রদের সমর্থন করছেন। তবে এর মানে হলো- একটি বড় দায়িত্ব একজন ব্যক্তির ওপর অর্পণ করা, যাকে অধিকার রক্ষা এবং সেই সব সুযোগ তৈরি করার প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে, যেগুলো ছাত্রদের অনেক বন্ধু ও সহকর্মী জীবিত থাকতে দেখতে পাননি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী প্রাপ্তি তপসীর কথায়, আমরা পড়তে চাই, লিখতে চাই, গবেষণা করতে চাই। রাষ্ট্রের উচিত সেই দায়িত্ব পালন করা।