পঞ্চদশ সংশোধনীর রায়ে যেসব বিধান বাতিল হলো

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:১২

২০১১ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্তত ৫৪ বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে দুটি রিট করা হয়। ওই রিটের ওপর জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে আজ রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে গণভোট, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দেওয়া বিধান অবৈধ ও বাতিল করেন হাইকোর্ট। বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আগামী জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন আদালত। রায়ে আদালত বলেন, সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে বিধানগুলো সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে।
এ বিষয়ে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ আবেদনকারীর আইনজীবী ড. শরীফ ভুঁইয়া বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার বিধান বাতিল হলো; সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ এবং সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য সংক্রান্ত ৭ক এবং ৭খ বাতিল হলো, মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের বিধান নিয়ে হাইকোর্টের ক্ষমতা কমানো বিষয়ক ৪৪ (২) বাতিল করা হলো। এছাড়া ১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোটের বিধান বাতিল করাকে বাতিল করা হয়েছে। ফলে সংবিধানের প্রস্তাবনা ও কিছু অনুচ্ছেদ সংশোধনে আজ রায়ে গণভোটের বিধান ফিরে আসছে।
তিনি বলেন, ৭ক এবং খ , ৪৪ (২) ও ১৪২ অনুচ্ছেদ বিষয় আজকের রায়ের ফলে বাস্তবায়িত হলো। তবে সংসদের মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হলো— সেটার প্রতিবন্ধকতা আজকে পার হলাম। বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে যে রায় (তত্ত্ববধায়ক অবৈধ) সেটার পুনর্বিবেচনা পরে হতে হবে ব্যবস্থাটা ফিরে আসার জন্য। সেটা জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে শুনানি হবে। যদি রিভিউ আমাদের পক্ষে আসে তাহলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরবে।

যেসব বিষয় বাতিল করা হলো
এক. সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ, ইত্যাদি অপরাধ সংক্রান্ত ৭ক অনুচ্ছেদে (১) বলা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়-

(ক) এ সংবিধান বা ইহার কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা (খ) এ সংবিধান বা ইহার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে— এ কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।

(২) কোনো ব্যক্তি (১) দফায় বর্ণিত— (ক) কোনো কার্য করিতে সহযোগিতা বা উসকানি প্রদান করিলে; কিংবা (খ) কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে— এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে।

(৩) এ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে।
সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য সংক্রান্ত ৭ ‘খ’তে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সব অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।

দুই. মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ সংক্রান্ত ৪৪ (২) এ বলা হয়েছে, এই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটাইয়া সংসদ আইনের দ্বারা অন্য কোন আদালতকে তাহার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ওই সকল বা উহার যে কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা দান করিতে পারিবেন।

তিন. তত্ত্বাবধায়ক সংক্রান্ত ৫৮ক অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত এবং ক পরিচ্ছেদ এ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত।

চার. সংবিধানের বিধান সংশোধনের ক্ষমতা সংক্রান্ত গণভোটের বিধান বাতিল সংক্রান্ত ১৪২ এর অনুচ্ছেদ। আদালত বলেছেন, গণভোট সংক্রান্ত ১২তম সংশোধনী এখানে বহাল হবে।
এর আগে ৪ ডিসেম্বর পৃথক রিটে জারি করা রুলের ওপর শুনানি শেষ হয়।
২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং রাষ্ট্রপতি ২০১১ সালের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়; সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়।
অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও যুক্ত করা হয়। আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান থাকলেও ওই সংশোধনীতে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়টি সংযোজন করা হয়।
এই সংশোধনী বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি। গত ১৯ আগস্ট হাইকোর্ট রুল জারি করেন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে।
পরে এ রুল সমর্থন করে সহায়তাকারী (ইন্টারভেনার) হিসেবে যুক্ত হন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গণফোরাম, বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা। তাদের পক্ষে তাদের আইনজীবীরা বক্তব্য উপস্থাপন করেন।এছাড়া নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনও রিট করেন।