আগামী মাসের (ফেব্রুয়ারি) প্রথম সপ্তাহের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশ প্রতিবেদন দাখিল করতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। কমিশনের সদস্যরা জানিয়েছেন, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন, জনমুখী প্রশাসন গঠনের লক্ষ্য নিয়ে তারা সুপারিশ প্রতিবেদন প্রস্তুত করছেন। সুপারিশে ঠিক কী থাকছে সেটা নিয়ে এখনই মন্তব্য করতে চান না তারা।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের একান্ত সচিব (পিএস) পদে ক্যাডার কর্মকর্তা নয়, রাজনৈতিকভাবে নিয়োগের প্রস্তাব দিতে পারে কমিশন। এছাড়া কমিশন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংখ্যা কমানোর পাশাপাশি একই বা কাছাকাছি ধরনের মন্ত্রণালয়গুলো নিয়ে পাঁচ-ছয়টি গুচ্ছ করা নিয়ে আলোচনা করছে।
আমরা কমিশনের সদস্যরা নিরপেক্ষ। অনেকে আছি বিভিন্ন ক্যাডারের সাবেক অফিসার। অবসরের পর তো আমরা কোনো ক্যাডারের নই। রাষ্ট্র একটা অন্যতম পবিত্র দায়িত্ব আমাদের দিয়েছে। আমাদের দায়িত্ব সবার প্রতি ন্যায় বিচার করা।- কমিশনের সদস্য সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া
এছাড়া দেশকে চারটি প্রশাসনিক প্রদেশে বিভক্ত করা এবং উপসচিব পদে প্রশাসন ছাড়া অন্য ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে কমিশন সুপারিশ দিতে পারে।
তবে সুপারিশের বিষয়ে কমিশনের কোনো কর্মকর্তা এখনই কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানান। তারা বলেন, চলতি মাসের মধ্যে শেষ করে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দাখিলের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে কমিশন। সবাই অঙ্গীকার করেছি, চূড়ান্ত দাখিল না করা পর্যন্ত কী সুপারিশ করা হচ্ছে সে বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলবো না।
গত ৩ অক্টোবর ১১ সদস্যের জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এ কমিশনের প্রধান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা করে তুলতে এ কমিশন গঠন করা হয়। ৯০ দিনের (তিন মাস) মধ্যে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করতে বলা হয়। এরপর তিন দফা বাড়িয়ে কমিশনের মেয়াদ ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
কেউ যাতে স্বৈরাচার হয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য দরকার জবাবদিহিতা। যেটা আমরা খুবই শক্তভাবে দেখছি যে, কেউ যাতে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে না থাকে। জবাবদিহিতা না থাকার ফলে আজ আমরা এ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি।- কমিশনের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ কা ফিরোজ আহমেদ
সংশ্লিষ্টরা জানান, জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোসহ জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুধাবনে কমিশন ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগ, ছয়টি জেলা এবং চারটি উপজেলা সফর করে অংশীজনদের মতামত ও পরামর্শ সংগ্রহ করে। কমিশন এ পর্যন্ত ২০টির বেশি সভা করেছে। এক লাখেরও বেশি ব্যক্তির কাছ থেকে জনপ্রশাসন সংস্কার সংশ্লিষ্ট প্রাপ্ত অনলাইন মতামত এবং নাগরিক পরিষেবা সম্পর্কে নাগরিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সুনির্দিষ্ট অভিমত পেয়েছে কমিশন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকেও পেয়েছে সংস্কার প্রস্তাব।
তাছাড়া কমিশনের সদস্যরা সবশেষ ৬ থেকে ৭ জানুয়ারি কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলা এবং মতলব উপজেলার অংশীজন ও মাঠ পর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন বিভাগের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে তথ্য সংগ্রহ করেন।
আমরা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের মতামত নিয়েছি। সবার মতামতের ভিত্তিতেই আমরা কাজ করছি। তারা কী বলছে, কী চাইছে, মানুষের কী প্রয়োজন, জনগণ আগামী দিনে প্রশাসনকে কেমন দেখতে চায়- এটার ওপর আমরা কাজ করছি।- কমিশনের সদস্য সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. মো. হাফিজুর রহমান ভুঞা
যা বলছেন কমিশনের সদস্যরা
কমিশনের সদস্য সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা কমিশনের সদস্যরা নিরপেক্ষ। অনেকে আছি বিভিন্ন ক্যাডারের সাবেক অফিসার। অবসরের পর তো আমরা কোনো ক্যাডারের নই। রাষ্ট্র একটা অন্যতম পবিত্র দায়িত্ব আমাদের দিয়েছে। আমাদের দায়িত্ব সবার প্রতি ন্যায় বিচার করা। আমরা যেটা মনে করবো, যেটা ন্যায্য সেটাই করবো। মানুষের ভুল হতে পারে, কিন্তু আমাদের কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে যেটা মনে করছি, আমাদের সবার জন্য ভালো, আমরা সেটা করবো।’
কমিশনের আরেক সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ কা ফিরোজ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এমন একটি প্রশাসন নিশ্চিত করতে চাই যা বৈষম্য নিরসনে কাজ করবে। এ প্রশাসনের ভেতরেও কোনো বৈষম্য থাকবে না, সেটি মাথায় রেখেই আমরা কাজ করছি। প্রশাসন যাতে জনমুখী হয়, সেটা করতে যা যা দরকার- ইনস্টিটিউশনাল অ্যারেজমেন্ট, আমাদের প্রবণতা হলো ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা।’
‘এটা আমাদের দুর্বিনীত করে ফেলে, ফ্যাসিস্ট করে ফেলে। তাই অবকাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য আমরা চিন্তা করছি। যাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না হয়। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে যাতে স্বৈরাচার বা গণবিরোধী কোনো শক্তির উত্থান না হতে পারে। বিস্তৃত পরিসরে আমরা মূলত এই ফ্রেমওয়ার্কে কাজ করছি।’
তিনি বলেন, ‘এছাড়া কেউ যাতে স্বৈরাচার হয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য দরকার জবাবদিহিতা। যেটা আমরা খুবই শক্তভাবে দেখছি যে, কেউ যাতে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে না থাকে। জবাবদিহিতা না থাকার ফলে আজ আমরা এ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি।’
ফিরোজ আহমেদ আরও বলেন, ‘আমরা খুবই সংবেদশীল বিষয় নিয়ে কাজ করছি। যারা প্রশাসনে আছেন, জনগণ, সরকার- সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো অনেককে সন্তুষ্ট করতে পারবো না। কিন্তু আমরা আমাদের অঙ্গীকারের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট। একটা জনমুখী প্রশাসন ও এই প্রশাসনের ওপর ভর করে যাতে একটা বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে ওঠে- এই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। এজন্য যত সমালোচনা আসুক না কেন, সেদিকে আমরা তাকাচ্ছি না। তবে মানুষ হিসেবে সীমাবদ্ধতা তো থাকবেই। সদস্য যারা আছেন, তাদের কারও কমিটমেন্টের ঘাটতি নেই, এটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি।’
‘আমাদের মানদণ্ডটা হবে যাতে বৈষম্য না করা হয়। সুযোগ-সুবিধা যাতে সবার জন্য সমান থাকে। সেটা আমরা দেখছি।’
কমিশনের সদস্য সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. মো. হাফিজুর রহমান ভুঞা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের মতামত নিয়েছি। সবার মতামতের ভিত্তিতেই কাজ করছি। তারা কী বলছে, কী চাইছে, মানুষের কী প্রয়োজন, জনগণ আগামী দিনে প্রশাসনকে কেমন দেখতে চায়- এটার ওপর আমরা কাজ করছি। মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে মিলিয়ে আমরা সুপারিশ প্রস্তুত করছি।’
যা থাকতে পারে সুপারিশে
সংশ্লিষ্টরা জানান, কমিশন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের সব কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে। কোনটি রাখা হবে, কোনটি রাখা হবে না- তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলছে।
সাধারণ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সরকারি উচ্চপদস্থ বা নীতি-নির্ধারণী ব্যক্তিদের পিএস হিসেবে নিয়োগ পান। পিএস নিয়োগ পাওয়া এ কর্মকর্তারা রাজনৈতিক সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে পরবর্তীসময়ে চাকরি জীবনে সমস্যায় পড়েন। সরকার পরিবর্তনে তাদের স্বাভাবি চাকরি জীবন অব্যাহত থাকে না। ওএসডিসহ নানান শাস্তি পেতে হয় তাদের। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কমিশন রাজনৈতিকভাবে পিএস নিয়োগের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। কমিশনকে দেওয়া বিএনপির জনপ্রশাসন সংস্কার প্রস্তাবেও এ বিষয়টি আছে।
সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সংস্কার কমিশন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পাঁচ বা ছয়টি গুচ্ছের (ক্লাস্টার) সুপারিশ করার পরিকল্পনা করছে যেখানে নির্দিষ্ট ক্যাডারের কর্মকর্তারা কাজ করবেন।
এছাড়া সংস্কার কমিশন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংখ্যা ৩০ বা এর নিচে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করতে পারে বলে সূত্রে জানা যায়। এটি করা হলে সমন্বয়ে সুবিধার সঙ্গে সঙ্গে পরিচালন ব্যয়ও কমে যাবে বলে মনে করেন কমিশনের কোনো কোনো সদস্য। বর্তমানে সরকারের ৫৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ রয়েছে। কমিশন এ প্রস্তাব দিলে এবং তা সরকার বাস্তবায়ন করলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিভাগগুলো একীভূত হবে। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দু-বিভাগ একীভূতের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিভাগগুলো মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে আসবে।
কমিশন দেশকে চারটি প্রশাসনিক প্রদেশে বিভক্ত করার প্রস্তাব করতে পারে। সূত্র জানায়, বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করার জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং খুলনা- এ চার প্রদেশ গঠনের সুপারিশের চিন্তা করছে কমিশন।
এছাড়া সংস্কার কমিশন উপসচিব পদের জন্য একটি নতুন পদোন্নতির বিধান চালু করতে চাইছে, সে অনুযায়ী প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ ও অন্য ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তা উপসচিব পদে পদোন্নতি পাবেন।
এ খসড়া সুপারিশের কথা আগেই কমিশনের চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময়ে জানিয়েছিলেন। এটি তখন প্রশাসনে আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব চরম উসকে দেয়। প্রশাসন ক্যাডার ও ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা কমিশনের এ চিন্তাকে ভালোভাবে নেয়নি। বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ কর্মকর্তা এবং বাকি ২৫ ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা উপসচিব পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন।