ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ গতকাল রবিবার দিবাগত গভীর রাত পর্যন্ত চলে। এতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ, থেমে থেমে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত উভয়পক্ষের শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্যে রাত ১২টার দিকে পুলিশ মাঝখানে অবস্থান নিয়ে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং লাঠিচার্য করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের পাশাপাশি চার প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্য মোতায়েন করা হয়।
এদিকে, এই সংঘর্ষের ঘটনায় আজ সোমবার ঢাবিতে সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। রাত ২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রফিকুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। জনসংযোগ দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনিবার্য কারণে ২৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা ও ক্লাস স্থগিত করা হয়েছে। অন্যদিকে ৫ দফা দাবিতে ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে অবরোধ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
এই সংঘর্ষের ঘটনাকে ‘অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক’ বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদ। রাত ১টার দিকে এক ভিডিওবার্তায় তিনি বলেন, এতে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছেন। এর আগে মামুন আহমেদের বিরুদ্ধে সাত কলেজের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে অপমান করার অভিযোগ এনে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় তার ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়ে সন্ধ্যা থেকে সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ এবং সেখান থেকে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের দিকে মিছিল নিয়ে আসেন।
জানা গেছে, সাত কলেজের ভর্তির আসন কমানোসহ ৫ দফা দাবি নিয়ে গতকাল বিকালে শতাধিক শিক্ষার্থী আলোচনা করতে ঢাবির উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদের কার্যালয়ের সামনে যান। এ সময় অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ দুই-তিনজন প্রতিনিধিকে তার কার্যালয়ে এসে কথা বলতে অনুরোধ করেন। তবে তার অনুরোধ না রেখেই সবাই কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় ‘মব’ সৃষ্টি হলে ড. মামুন আহমেদ তাদের সঙ্গে আর কথা বলেননি। পরে এর প্রতিক্রিয়ায় সেখান থেকে তারা বেরিয়ে অবরোধ শুরু করেন বলে জানা যায়। তবে, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আফজাল হোসেন বলেন, আমরা পাঁচ দফা দাবি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের কাছে গেলে তারা আমাদের অপমান করে বের করে দেয়। এখন শিক্ষার্থীদের নিকট ক্ষমা
চাওয়াসহ সব দাবি রাতের মধ্যে মেনে নিতে হবে। না মানলে রাস্তা ছাড়ব না।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নীলক্ষেত মোড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে কয়েকশ’ শিক্ষার্থী বেরিয়ে এসে তাদের ধাওয়া দেন। এতে নীলক্ষেত মোড় থেকে কিছুটা সরে যান সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরে তারা আবার একজোট হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেন। পাল্টাপাল্টি এ ধাওয়া চলে গভীর রাত পর্যন্ত। রাত ১টার দিকে ভিডিও বার্তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ বলেন, ‘সন্ধ্যায় সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার অফিসে আলোচনাকে কেন্দ্র করে রাতে যে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে তা দুঃখজনক। এতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত।
মামুন আহমেদ বলেন, আমি বিশ্বাস করি, সুষ্ঠু পরিবেশে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে এই ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে তা প্রশমন করার জন্য সব পক্ষকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান করছি।
শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা দাবি হলো ২০২৪-২৫ সেশন থেকেই সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি বাতিল করতে হবে, শ্রেণিকক্ষের ধারণক্ষমতার বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি না করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা, ভর্তি পরীক্ষায় ভুল উত্তরের জন্য নম্বর কাটতে হবে ও সাত কলেজের ভর্তি ফির স্বচ্ছতা নিশ্চিতে মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত নতুন অ্যাকাউন্টে ভর্তি ফি জমা রাখতে হবে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ বলেন, তারা এসেছিল আমার সঙ্গে কথা বলতে। তখন আমি তাদের বলি, তোমরা সবাই না এসে দুজন আসো। কিন্তু অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী ধাক্কাধাক্কি করে ভেতরে ঢুকে যায়। ঘটনা এতটুকুই। সেখানে তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের খারাপ আচরণ করা হয়নি। মামুন আহমেদ আরও জানান, শিক্ষার্থীদের পাঁচ দফা বিষয়ে আজ সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় সাত কলেজের বিষয়ে যে কমিটি আছে, তাদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে।
ঢাকা কলেজ থেকে ইডেন মহিলা কলেজ পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালিয়ে অবস্থান করছেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকা কলেজের সামনে, নিউমার্কেটের সামনে, নীলক্ষেত মোড়ে ও ইডেন কলেজের সামনের সড়কে কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালিয়েছেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরে রাত আড়াইটার দিকে সড়ক ছেড়ে দিলে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী নিয়ন্ত্রণে নেয়।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলা অবস্থায় সংঘর্ষস্থলে রাত সাড়ে ১২টার দিকে নীলক্ষেত এলাকায় হাজির হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনার চেষ্টা করতে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন তিনি। পরে তিনি ক্যাম্পাসের দিকে চলে যান।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাত সাড়ে ১১টার সময় ঢাবি উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদের বাসভবন অবরোধের জন্য আন্দোলনরত সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেতসংলগ্ন ঢাবির প্রবেশপথের বাইরে অবস্থান করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভেতরে অবস্থান নেন। মাঝখানে অবস্থান করছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তখন দুপক্ষ থেকে ভুয়া ধ্বনি দেওয়া হয়। একপর্যায়ে ঢাবি শিক্ষার্থীরা ধাওয়া দিলে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা নিউমার্কেটের দিকে পিছু হটে। নিউমার্কেট থেকে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ইটপাটকেল ছুড়ে।
গতকাল রবিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকা কলেজসংলগ্ন মিরপুর সড়ক অবরোধ করেন। এতে সায়েন্সল্যাব, নীলক্ষেত মোড় ও এলিফ্যান্ট রোডসহ আশপাশে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। পরে রাতে সংঘর্ষ বেধে যায়।
এদিকে রাত আড়াইটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান ক্যাম্পাসে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এ ঘটনায় তিনি গভীরভাবে মর্মাহত উল্লেখ করে এক বিবৃতিতে সবাইকে ধৈর্য ধারণের এবং সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এ অবস্থায় কোনো তৃতীয় পক্ষ যেন সুযোগ নিতে না পারে সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
উপাচার্য বলেন, আজ ২৭ জানুয়ারি অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে। যে সব বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন, সেগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।