রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট আরও গভীর হচ্ছে। গত বছরের আগস্টে মিয়ানমারে নতুন করে সহিংসতার কারণে ৮০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে যা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত অনিশ্চিত পরিস্থিতির দিকে ধাবিত করেছে।
রোববার (২৬ জানুয়ারি) রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত “জেন্ডারড ভায়োলেন্স অ্যান্ড ইনসিকিউরিটি ইন দ্য রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্যাম্পাস ইন বাংলাদেশ: নিউ ইনসাইটস অ্যান্ড ওয়েজ ফরোয়ার্ড” শীর্ষক এক সেমিনারে উপস্থাপিত একটি গবেষণায় এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।
বন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর কনফ্লিক্ট স্টাডিজ এবং রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট দ্বারা পরিচালিত এই সমীক্ষা, ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার অবস্থা, লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে নিরাপত্তা উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা স্থান পায় কর্মশালায়।
কর্মশালার আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশীদ, বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনার ডেপুটি হাইকমিশনার জেমস গোল্ডম্যান। বিআইসিসিআর'র সিনিয়র গবেষক ড. বেঞ্জামিন এটজল্ড 'নিউ ট্রেন্ডস অব জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্স অ্যান্ড ইনসিকিউরিটি ইন দ্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পাস' শীর্ষক গবেষণাপত্র কর্মশালায় উপস্থাপন করেন।
গবেষণাপত্রের ওপর আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দা রোজানা রশিদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার উইংয়ের মহাপরিচালক ফেরদৌসী শাহরিয়ার, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. সি আর আবরার, ইংল্যান্ডের সাসেক্স ইউনিভার্সিটির সিনিয়র গবেষক ড. সোহেলা নাজনীন এবং ঢাবির শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের ড. রফিকুল ইসলাম।
কর্মশালায় প্রধান অতিথি মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নারীদের ওপর বহুভাবে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সেখানে জোরপূর্বক বাল্যবিবাহ দেয়া হচ্ছে। একে তো তারা কবে মাতৃভূমিতে ফিরবে তা আমরা জানি না। তাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে এবং আরাকানের শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে আমি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন চালু করার অনুরোধ করছি। এই অঞ্চলে পদ্ধতিগত অস্থিতিশীলতার মতো মূল কারণগুলিকে মোকাবেলা করা উচিত। আমাদের এটিকে আরেকটি মানবিক সংকট হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। আমরা অন্তর্নিহিত কারণগুলি মোকাবিলা না করলে সহিংসতা এবং বাস্তুচ্যুতির চক্র অব্যাহত থাকবে।
কর্মশালায় বিশেষজ্ঞরা রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী সমাধান খুঁজতে সম্মিলিত পদক্ষেপে অংশগ্রহণের জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দা রোজানা রশিদ বলেন, অনেক শরণার্থী প্রত্যন্ত এবং দুর্বলভাবে পর্যবেক্ষণ করা এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে, যার ফলে আগমনকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের জীবনের জন্য ছুটে চলা লোকেরা সীমান্ত অতিক্রম করার উপায় খুঁজে পায়, বিশেষ করে এমন অঞ্চলে যেখানে আমাদের উপস্থিতি সীমিত।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার ১২ লাখের বেশি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। এই সংকট মোকাবেলায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার উইংয়ের মহাপরিচালক ফেরদৌসি শাহরিয়ার বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলমান কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় মালয়েশিয়া ও চীনের ভূমিকা রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, শরণার্থী শিবিরগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়াবহ। অনেক শরণার্থী তাদের পরিবারকে সমর্থন করার জন্য অনানুষ্ঠানিক শ্রমের আশ্রয় নিচ্ছে।
তিনি উল্লেখ করেন যে উদ্বাস্তুদের প্রতিদিন এক বেলা খাবারের জন্য মাত্র ১৬ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এ কারণে রোহিঙ্গারা নির্মাণ শ্রমিক, মাছ ধরার কাজ এবং কৃষিতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন,শরণার্থী শিবিরের মধ্যে নারীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, জোরপূর্বক বিয়ে এবং মানসিক আঘাত সাধারণ হয়ে উঠেছে।
বিআইসিসি'র সিনিয়র গবেষক বেঞ্জামিন এটজল্ডের মতে, শুধুমাত্র ২০২৪ সালের প্রথমার্ধেই সশস্ত্র গোষ্ঠীর দ্বারা শিবির থেকে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার যুবক নিয়োগ করা হয়েছিল। আরসা, আরএসও এবং আরাকান আর্মিসহ এই গোষ্ঠীগুলি জোরপূর্বক যুবকদের নিয়োগ করে, প্রায়শই তাদের নির্যাতন, পাচার এবং মিয়ানমারে সশস্ত্র দলগুলির জন্য লড়াই করার জন্য বাধ্য করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দা রোজানা রশিদ গবেষণার আলোচনায় রোহিঙ্গা নারীদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্রঋণ উদ্যোগ এবং শিক্ষামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে জীবিকার সুযোগ বাড়ানোর সুপারিশ করেন।