সহজ হচ্ছে সঞ্চয়পত্র কেনা, টকটাইম-সিমে বাড়ছে না ভ্যাট

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১২ মে ২০২৫, ২০:১৫

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট ঘোষণা করা হবে আগামী ২ জুন। এই বাজেট ঘোষণা নিয়ে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। এ নিয়ে ১৯ মে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো চূড়ান্ত করছে এনবিআর।
জানা যাচ্ছে, জাতীয় সঞ্চয়পত্র কিনতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা উঠে যাচ্ছে এবার। মোবাইলে টকটাইম, সিম ও ইন্টারনেটের ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাটের হার অপরিবর্তিত থাকছে। আর সিগারেটে অপরিবর্তিত থাকছে ভ্যাটের খড়গ।
১৯ মে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা, এনবিআর চেয়ারম্যান, অর্থ সচিব ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সঞ্চয়পত্র কিনতে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থাকছে না
উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে এক বছর ধরে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। সঞ্চয়পত্র ভেঙে বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট বা প্রকৃত ঋণ ঋণাত্মক হয়ে গেছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সাড়ে ৮৩ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্য সরকারের। এই লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ৩৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে প্রথম সাত মাসে ৪৩ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙা হয়েছে।
বর্তমানে পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে আগের বছরের আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা দিতে হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সীমিত ও মধ্যম আয়ের মানুষরা। এবার পাঁচ লাখ বা তার বেশি টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে নিতে পারে সরকার। নতুন বাজেটে এ সুযোগ রাখা হতে পারে। এর ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আরও সহজ হবে।
এনবিআর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের জটিলতা বা ভোগান্তি কমাতে এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের আয়কর বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজেটে সঞ্চয়পত্র কেনায় রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র (পিএসআর) দেখানোর বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হতে পারে। অথবা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সঞ্চয়পত্র কেনার সীমা পর্যন্ত এই সুবিধা দেওয়া হতে পারে। এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেককেই করযোগ্য আয় না থাকা সত্ত্বেও শুধু সঞ্চয়পত্র কেনার কারণে প্রতিবছর রিটার্ন জমা দিতে হয়। এতে অনেকেই ভোগান্তির সম্মুখীন হন। এবার এটা সহজ করা হবে।
‘স্বল্প আয়ের মানুষের রিটার্ন জমা দেওয়ার মতো করযোগ্য আয় নেই। কিন্তু তাদের ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র আছে। এখন এই বাধ্যবাধকতা উঠে গেলে রিটার্ন জমায় হয়রানিও কমে যাবে।’- এনবিআরের সাবেক সদস্য (করনীতি) ড. সৈয়দ আমিনুল করিম
এছাড়া ব্যাংকে ১০ লাখ টাকা বা তার বেশি মেয়াদি আমানত খুলতেও রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেওয়ার বাধ্যবাধকতাও উঠিয়ে নিতে পারে সরকার। আর চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, হিসাববিদ, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ারসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ পেতে এবং তা বহাল রাখতেও এ ধরনের বিধান থাকছে না। তবে এসব সেবায় টিআইএন থাকতে হবে। সব মিলিয়ে ১০ সেবায় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র উঠিয়ে নিতে পারে সরকার। বর্তমানে দেশে ৪৫টি সরকারি-বেসরকারি সেবা পেতে গেলে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র বা পিএসআর দেখাতে হয়।
সঞ্চয়পত্রে পিএসআর উঠানোর এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে এনবিআরের সাবেক সদস্য (করনীতি) ড. সৈয়দ আমিনুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বল্প আয়ের মানুষের রিটার্ন জমা দেওয়ার মতো করযোগ্য আয় নেই। কিন্তু তাদের ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র আছে। এখন এই বাধ্যবাধকতা উঠে গেলে রিটার্ন জমায় হয়রানিও কমে যাবে।’
বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর। এগুলো হলো, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্র। এর মধ্যে পরিবার সঞ্চয়পত্রের চাহিদা সবচেয়ে বেশি আর শুধু নারীরাই এই সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন।
এদিকে, গত ডিসেম্বরে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ায় সরকার। তার মধ্যে তামাক জাতীয় পণ্যের সম্পূরক শুল্ক বাড়ায় সরকার। বর্তমানে সিগারেটে ভ্যাট রয়েছে ১৫ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা অপরিবর্তিত থাকছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটে ভ্যাট সাড়ে সাত শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। আবার জানুয়ারিতে তিন স্তরের সিগারেটে সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ৬৭ শতাংশ করা হয়। এক অর্থবছরে দুই বার কর বাড়ানোর কারণে এবার সিগারেটে ভ্যাট না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে সরকার।
জানুয়ারিতে নিম্ন স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের দাম ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০ টাকা করা হয়। এতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক ৬০ শতাংশ থেকে ৬৭ শতাংশ করা হয়। এছাড়া মধ্যম স্তরে ৭০ টাকা থেকে ৮০ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৬৭ শতাংশ করা হয়। উচ্চ স্তরে ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪০ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। আর অতি উচ্চস্তরের সিগারেটের দাম ১৬০ টাকা থেকে ১৮৫ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ শতাংশ করা হয়।
‘এটা মানুষের কাছে সহনীয় হয়ে গেছে। একবারে অনেক বাড়াতে হবে। সিগারেটে করহার আরও বাড়াতে হবে। সিগারেটের মূল্যস্তর কমাতে হবে। খুচরা সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে। সর্বোপরি সিগারেট কোম্পানিগুলোর ছলচাতুরি বন্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে।’- উন্নয়ন সমন্বয়ের হেড অব প্রোগ্রাম শাহীন উল আলম
জানুয়ারির আগে খুচরা পর্যায়ে একটি ব্র্যান্ডের প্রতি শলাকা সিগারেটের দাম ছিল ১৮ টাকা, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। আরও একটি ব্র্যান্ডের প্রতিটি শলাকার দাম ১৩ টাকা থেকে বেড়ে ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া একটি ব্র্যান্ডের প্রতি শলাকা সিগারেটের দাম দুই টাকা বেড়ে ১২ টাকা করা হয়েছে। এর বাইরে কয়েকটি ব্র্যান্ডের সিগারেটের মূল্য এক টাকা করে বেড়েছে।
তবে এনবিআরের এ সিদ্ধান্তে খুশি নয় তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো। জানতে চাইলে উন্নয়ন সমন্বয়ের হেড অব প্রোগ্রাম শাহীন উল আলম জাগো নিউজকে বলেন, দুইবার বাড়ানো হয়েছে বলে এনবিআরের আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। এখানে আরও কর বাড়ানোর সুযোগ আছে। এখন পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সিগারেটের দাম অনেক কম। এজন্য বাংলাদেশ থেকে যখন কেউ বিদেশে যায় তখন প্রবাসীরা সিগারেট আনার বায়না করেন।
সিগারেটের মূল্যবৃদ্ধিকে সহনীয় উল্লেখ করে শাহীন উল আলম বলেন, ‘এটা মানুষের কাছে সহনীয় হয়ে গেছে। একবারে অনেক বাড়াতে হবে। সিগারেটে করহার আরও বাড়াতে হবে। সিগারেটের মূল্যস্তর কমাতে হবে। খুচরা সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে। সর্বোপরি সিগারেট কোম্পানিগুলোর ছলচাতুরি বন্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে।’
বাজেটে সিগারেটের ওপর আর কর না বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানও। এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, সিগারেটের ওপর আর কর বাড়ানো হবে না।

টকটাইম, ইন্টারনেটে ভ্যাট বাড়ছে না
চলতি অর্থবছরের বাজেটে মোবাইল টকটাইম ও ইন্টারনেট সেবার ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়। এছাড়া সিম বিক্রিতে ১০০ টাকা ভ্যাট বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়। জানুয়ারিতে মুঠোফোনের সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে টেলিফোন সেবায় (টকটাইম, ইন্টারনেট ব্যবহার ইত্যাদি) সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তা বাড়েনি।
গত অর্থবছরের বাজেট অনুযায়ী মোবাইল সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও সারচার্জ মিলিয়ে মোট করভার ৩৯ শতাংশের বেশি আছে। আগামী বাজেটে তা আর বাড়ানো হবে না বলে জানিয়েছেন ভ্যাট বিভাগের এক কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘গত বাজেটে মোবাইল সেবার ওপর ভ্যাট বাড়িয়েছি। এবার আর বাড়তি কিছু বসছে না। গত বছর যেগুলোর ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে সেগুলোর ওপর করের বোঝা বাড়ছে না।’
‘সব কিছুই যেহেতু আমরা পুনর্মূল্যায়ন করছি, মোবাইল ফোন সেবায় সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাটের বিষয়টিও রিভিউ করা দরকার আছে। এটা আমরা দাবি করেছিলাম। এখানে সংস্কার করে করহার যৌক্তিক করা প্রয়োজন।’- মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ
অপরদিকে, আগামী বাজেটে মোবাইল ফোন সেবার ওপর ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ১ শতাংশ সারচার্জ কমানোর সুপারিশ করেছে দেশের মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো। তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) এ দাবি জানিয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া প্রাক-বাজেট আলোচনায় অ্যামটব মহাসচিব মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন, বৈশ্বিক বিবেচনায় মোবাইল ফোন অপারেটররাই সবচেয়ে বেশি কর প্রদান করে থাকে। তদুপরি সরকার প্রায় প্রতিবছর এই খাতে কর বৃদ্ধি করে আসছে, যার বিরূপ প্রভাব গ্রাহকদের ওপর পড়ছে।
একই দাবি মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের। সংগঠনটির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সব কিছুই যেহেতু আমরা পুনর্মূল্যায়ন করছি, মোবাইল ফোন সেবায় সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাটের বিষয়টিও রিভিউ করা দরকার আছে। এটা আমরা দাবি করেছিলাম। এখানে সংস্কার করে করহার যৌক্তিক করা প্রয়োজন।’
‘ব্যান্ডউইথের দাম কমানো হয়েছে, আরও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গ্রাহক এর সুফল পাচ্ছে না। মোবাইল অপারেটররা দাম কমাচ্ছে না। তারাও করহার কমানোর দাবি করছে’, যোগ করেন মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি আরও বলেন, মানুষের হাতে ডিভাইস কম, সাধ্যমতো ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছে না। করহারটা বৈষম্যমূলক। এটা অনেক বেশি, কমানো উচিত। কর, মূসক, শুল্ক এরপর করপোরেট কর যদি যুক্ত করেন তাহলে দেখা যায় গ্রাহক ১০০ টাকা রিচার্জ করলে তার প্রায় ৫৮ টাকা সরকারকে দিতে হয়।