দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এ সময়ে বন্দর থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬২৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা। বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৫৮১ কোটি ৫২ লাখ টাকা। পণ্য আমদানিতে কিছু জটিলতার কারণে আমদানি কমায় রাজস্ব ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা। সামনের দিনে মসলাজাতীয় পণ্য আমদানি বাড়লে রাজস্ব আহরণ বাড়বে দলে জানিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
হিলি স্থল শুল্ক স্টেশন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হিলি স্থলবন্দরে ৭৪০ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সেই মোতাবেক অর্থবছরের প্রথম জুলাই মাসে ৪৫ কোটি নয় লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৪৫ কোটি ৭৬ লাখ, আগস্ট মাসে ৬০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৫৮ কোটি ৩৯ লাখ, সেপ্টেম্বর মাসে ৫৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৫৫ কোটি সাত লাখ, অক্টোবর মাসে ৬২ কোটি ৬৫ লাখ টাকার বিপরীতে এসেছে ৬১ কোটি ৮৯ লাখ, নভেম্বর মাসে ৬৫ কোটি ১৯ লাখ টাকার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৪৩ কোটি ৮৯ লাখ, ডিসেম্বর মাসে ৬৯ কোটি ২১ লাখ টাকার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৫৩ কোটি ৫৬ লাখ, জানুয়ারি মাসে ৬৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকার বিপরীতে এসেছে ৪৯ কোটি ৩১ লাখ, ফেব্রুয়ারি মাসে ৫১ কোটি ৬১ লাখ টাকার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৭০ কোটি দুই লাখ, মার্চ মাসে ৭৬ কোটি ৩০ লাখ টাকার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৯৫ কোটি ৭৭ লাখ, এপ্রিল মাসে ৬৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৪৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি দেখা দিয়েছে এপ্রিল মাসে।
এ বিষয়ে হিলি কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফেরদৌস রহমান বলেন, ‘বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ করে শুল্কযুক্ত পণ্য আমদানি করলে এইচএসকোডের ফাঁদে ফেলে অতিরিক্ত শুল্ক আদায় করা হয়। একই পণ্য অন্য বন্দরে কম শুল্কায়ন করা হলেও এই বন্দরে বাড়তি মূল্যে শুল্কায়ন করার ফলে বেশি শুল্ক পরিশোধ করতে হয় আমদানিকারকদের। যার কারণে আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এই বন্দর দিয়ে আমদানি করতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এ ছাড়া কাস্টমসে যুগ্ম কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পদায়ন না থাকায় বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানিতে সময় বেশি লাগায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে আমাদের। বন্দরের অবকাঠামোগত তেমন উন্নয়ন না হওয়ায় ভারী যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে পণ্য ওঠা-নামানোর জন্য ইকুইমেন্ট না থাকায় অতিরিক্ত লোকসান গুনতে হয়। পাশাপাশি ফল আমদানির ক্ষেত্রে ট্রাকের চাকা অনুয়ায়ী শুল্কায়নের প্রথা চালু থাকায় বেশ কিছুদিন ধরে ফল আমদানি বন্ধ আছে। এসব কারণে বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি কমেছে। সেইসঙ্গে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।’
বন্দরের আমদানিকারক নূর ইসলাম বলেন, ‘আমদানি কমে যাওয়ার কারণ হলো গত কয়েকদিন ধরে হঠাৎ ডলারের দাম কিছুটা বেড়েছে। ব্যাংকে এলসি করার সময় আমরা প্রতি ডলার ১২২ টাকায় কিনছি। আবার পণ্য আমদানি করে বিল ছাড়ার সময় সেই ডলারের মূল্য দিতে হয় ১২৩ টাকা। এতে করে পণ্য আমদানিতে আমাদের পড়তা পড়ছে না। আবার কিছু পণ্যের দাম ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে পড়তা না পড়ায় আমদানিকারকরা পণ্য আমদানি করছেন না। পাশাপাশি কাস্টমসের কিছু জটিলতা রয়েছে। ১০ থেকে ২০ কেজি পণ্য বেশি হলে সেক্ষেত্রে বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে কাস্টমসে। এসব কারণে আমদানিকারকরা পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’
বন্দরের আরেক আমদানিকারক দয়াল মোল্লা বলেন, ‘আগে বন্দর দিয়ে প্রচুর পাথর আমদানি হতো। প্রতিদিন ১০০ ট্রাকের বেশি আমদানি হতো। এখন পাথর আমদানি একেবারে বন্ধ। কারণ দেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে পাথর আমদানি করা হলে কাস্টমস ও বন্দরের সব শুল্ক ও মাশুল পরিশোধ করে ব্যবসায়ীরা নিজস্ব ইয়ার্ডে নিয়ে বেচাকেনা করতে পারেন। কিন্তু এখানে বন্দরের ভেতরেই রাখতে হয়। ফলে অন্য বন্দরের তুলনায় খরচ বেশি পড়ায় আমদানি বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা।’
হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রফতানিকারক গ্রুপের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘হিলি দিয়ে মূলত চাল, পেঁয়াজ, ভুট্টা, খৈল, ভুসি এসব পণ্য বেশি আমদানি হয়। আগে প্রচুর পরিমাণ চাল আমদানি হলেও আইপির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ১৫ এপ্রিল থেকে বন্ধ রয়েছে। পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রেও আইপি বন্ধ থাকায় বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে পাঞ্জাব, হরিয়ানা থেকে যেসব পণ্য আসতো সেগুলো আসছে না। এজন্য আমদানি কমেছে। আবার ভারতে দাম বেশি অথচ বাংলাদেশে কম, যেসব পণ্য আমদানি করে লাভবান হতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এর প্রভাবেও আমদানি কমেছে। ফলসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি নিয়ে আমরা কাস্টমসের সঙ্গে আলোচনা করেছি। খুব শিগগিরই ফল আমদানি শুরু হবে। সেইসঙ্গে অন্যান্য পণ্য আমদানি আরও বাড়বে। তখন রাজস্ব আহরণও বাড়বে।’
রাজস্ব ঘাটতির কারণ জানতে চাইলে হিলি স্থল শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার কারণ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। ওই সময়ে বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি কমে গিয়েছিল। সেইসঙ্গে রেয়াতি শুল্কে চাল আমদানির সময়সীমা ছিল ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। এরপর মেয়াদ না বাড়ানোর কারণে আমদানি বন্ধ আছে। এ ছাড়া বন্দর দিয়ে প্রচুর পরিমাণ ভুসি আমদানি হলেও সেটি এখন বন্ধ। ফলে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আগামী জুন মাস পর্যন্ত সময় আছে অর্থবছরের। এ সময়ে বন্দর দিয়ে আমদানির পরিমাণ বাড়বে। কারণ সামনে কোরবানির ঈদ আছে। মসলাজাতীয় পণ্যের আমদানি বাড়লে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আমরা আশা করছি।’