হজ সেবায় পিয়ন গানম্যান মালি, নির্দেশনা অমান্য করে উপদেষ্টার সফরসঙ্গী স্ত্রী ও দুইবোন

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৪ জুন ২০২৫, ২২:৫২
আপডেট  : ১৫ জুন ২০২৫, ১৩:১১

প্রতিবারের ন্যায় এবারও হজ উপলক্ষে হাজিদের সেবা দিতে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচটি টিমের অধীনে ২৯৩ জন সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। এই টিমে যুক্ত রয়েছেন মন্ত্রণালয়ের মালি, গাড়িচালক, গানম্যান, অফিস সহায়ক বা পিয়ন, সচিবদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, কম্পিউটার অপারেটর, সাঁট মুদ্রাক্ষরিক, কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীরা। নীতিমালা মেনেই তাদের এই টিমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। তবে এই হজ টিম ও টিমের কার্যক্রম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
তারা বলছেন, এই টিমে যাদের যুক্ত করা হয়েছে, তাদের হজ সম্পর্কিত নানা বিষয়ে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ফলে সেবার মান সন্তোষজনক নয়।  
এদিকে সরকারি নির্দেশনা না মেনে ধর্ম উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হয়েছেন তার স্ত্রী ও দুই বোন। এ ছাড়া এক অতিরিক্ত সচিবের সঙ্গে তার স্ত্রী গেছেন বলেও জানা গেছে।
গত ২৩ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জারি করা বিদেশ ভ্রমণসংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সরকারিভাবে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের স্ত্রী/স্বামী/সন্তানদের সফরসঙ্গী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। হজ মনিটরিং দলের সফরসঙ্গী হিসেবে উপদেষ্টার স্ত্রী ও দুই বোন এবং অতিরিক্ত সচিবের স্ত্রীকে যুক্ত করা এ নির্দেশনার পরিপন্থী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হজ সংশ্লিষ্ট যেসব সেবা সৌদি সরকার দিয়ে থাকে, সেসব সেবার জন্য মন্ত্রণালয় অর্থ খরচ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হজ টিমের সদস্য করেছে। এটি এক ধরনের অন্যায় চর্চা বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানায়, হজ ব্যবস্থাপনার বেশিরভাগই বেসরকারি তদারকির ওপর নির্ভরশীল। এ অবস্থায় হাজিদের সেবার মান ও হজ মন্ত্রণালয়ের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে এ ধরনের টিম শুধু আর্থিক বোঝাই বড় করে, সেবার মানে গুণগত কোনো পরিবর্তন আনে না।
চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে হজে গিয়েছেন ৮৭ হাজার ১০০ জন। তাদের মধ্যে সরকারিভাবে গেছেন ৫ হাজার ২০০ জন। সরকারিভাবে যারা হজে যান তাদের সেবার মান বরবারই সন্তোষজনক নয়।
আবার যারা বেসরকারিভাবে হজে যান, তাদের সেবার দেখভাল সংশ্লিষ্ট এজেন্সিই করে থাকে। 
নতুন ধর্ম উদেষ্টা প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করছেন না মন্তব্য করে হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সাবেক দুই কর্মকর্তা বলেন, এজেন্সিগুলো যেভাবে হাজিদের যত্ন নেন, ধর্ম মন্ত্রণালয় সেটা করে না। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের টিমে যারা থাকেন, তারা বড় কর্মকর্তা নয়তো কর্মচারী। হাজিদের সেবা দেওয়ার বিষয়ে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। নতুন ধর্ম উপদেষ্টা পুরনো আমলের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনারই চর্চা করে যাচ্ছেন। সরকারিভাবে হজে যাওয়ার ক্ষেত্রে হজযাত্রীরা বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হন। 
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে ২৯৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চিকিৎসক কয়েকটি হজ টিমের সদস্য হিসেবে সৌদি আরব গেছেন। তাদের মধ্যে হজ প্রতিনিধি-মনিটরিং দলে ৬, প্রশাসনিক টিমে ৫৮, সমন্বিত চিকিৎসক টিমে ১৬৫, কারিগরি টিমে ২০ এবং হজ সহায়তাকারী টিমে ৪৪ জন সদস্য রয়েছেন।
হজ প্রতিনিধি-মনিটরিং দলের সদস্য হিসেবে বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন ছয়জন। তারা হলেন— ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, ধর্ম সচিব একেএম আফতাব হোসেন প্রামাণিক, অতিরিক্ত সচিব মো. মতিউল ইসলাম, তোফাজ্জল হোসেন, মো. ফজলুর রহমান ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আ. ছালাম খান। 
এ ছয়জনের সঙ্গে সফরসঙ্গী হিসেবে আরো চারজন হজ পালনের জন্য গেছেন। তারা হলেন— ধর্ম উপদেষ্টার স্ত্রী কামরুন্নেসা হাসিনা এবং উপদেষ্টার দুই বোন খন্দকার উম্মে সালমা ও আরিফা মাহবুবা। এ ছাড়া অতিরিক্ত সচিব ফজলুর রহমানের স্ত্রী মোরশেদা পারভীনও হজ মনিটরিং দলের সফরসঙ্গী হিসেবে যুক্ত হয়েছেন। যদিও সফরসঙ্গীরা নিজেদের অর্থে হজে গেছেন বলে জানিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
এবার ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে কারিগরি টিমে ২০ জন এবং হজ সহায়তাকারী টিমে ৪৪ জন সৌদি আরব গেছেন। যাদের বেশির ভাগই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। তারা হলেন—মন্ত্রণালয়ের গাড়িচালক আক্তারুজ্জামান সরকার, টিটু মিয়া ব্যাপারী, মো. বাকিউল আলম, নুর মোহাম্মদ, মো. জাহাঙ্গীর আলম, আবদুর রহিম, মো. আলমগীর হোসেন, শামীম হোসেন, মো. সালাহউদ্দিন; অফিস সহায়ক মনিরুল ইসলাম, মো. আশরাফুল ইসলাম, মো. আরমান, তানিয়া আক্তার, আনোয়ার হোসেন, মো. সোহাগ, ইমন মিয়া, সারোয়ার মাহমুদ; কম্পিউটার অপারেটর শাহাদাত হোসেন; অফিস সহকারী সুরাইয়া খাতুন; সাঁট মুদ্রাক্ষরিক মধুমালা, আমিনুল ইসলাম, ফারজানা সুলতানা, মমিনুল ইসলাম; গানম্যান সাইফুল হক, শাহ আলম; হজ অফিসের মালি বেগম সুমা আক্তার এবং জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররমের খাদেম মো. আবদুল মান্নান।
কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত সফরসঙ্গী না করার নির্দেশ থাকার পরও হজের বিভিন্ন টিমে তাদের যুক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন মাজহারুল ইসলাম, জাফর ইকবাল, রেক্সোনা আক্তার, ইকবাল হোসেন, শরিফুল ইসলাম, ইকরামুল হক, মো. আবদুল জব্বার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, ‘কারিগরি ও প্রশাসনিক সহায়তাকারী দলে এ শ্রেণীর কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কম্পিউটারের জ্ঞান আছে এমন কম্পিউটার অপারেটরদের/সাঁট মুদ্রাক্ষরিকদের আইটি দলে এবং বাকিদের প্রশাসনিক সহায়তা দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। হজ মৌসুমে মক্কা, মদিনা ও জেদ্দায় তিনটি অফিস চালু করার প্রয়োজন হয়। এখানে কম্পিউটার অপারেটর, অফিস সহকারী ও অফিস সহায়ক প্রয়োজন। সরকারি হাজিরা যেসব হোটেলে অবস্থান করেন, সেখানে সকাল ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত দুই শিফটে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে তিন-চারজনকে দায়িত্বে রাখা হয়। হাজিদের রুমের কোনো সমস্যা বা প্রয়োজন, তাদের মেডিকেল সেন্টারে পৌঁছে দেয়া, হারানো হাজিকে খুঁজে বের করা, অসুস্থ হাজির হজ পালনে সহায়তা প্রভৃতি কাজের দায়িত্ব এ শ্রেণীর কর্মচারীরা পালন করে থাকেন।’
ধর্ম উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘‌হাজিদের লাগেজ হারিয়ে গেলে তা খুঁজে বের করে হোটেলে পৌঁছে দেওয়া, কোনো হাজি অসুস্থ হলে তাকে মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া, পথ হারিয়ে ফেললে তাকে সংশ্লিষ্ট হোটেলে পৌঁছার ব্যবস্থা করা, কেউ মারা গেলে তার দাফনসহ অন্যান্য বিষয় তদারকি করা, বেসরকারি এজেন্সির হাজিদের আবাসন ও অন্যান্য বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া, কোনো হাজি যদি কোনো অভিযোগ করেন সেটা খতিয়ে দেখা, কোনো হাজি কখন মিনা-আরাফা-মুজদালিফায় যাবেন, কখন মদিনায় জিয়ারায় যাবেন, কখন দেশে ফিরবেন সেটা দেখভাল করার কাজ প্রশাসনিক দল ও প্রশাসনিক সহায়তাকারী দল করে থাকে। সুষ্ঠু ও সাবলীল হজ ব্যবস্থাপনার জন্য এসব দলের প্রয়োজন রয়েছে। গত বছর বিভিন্ন দলের সদস্য ছিল ৩৬৬ জন। এ বছর সেটা ২৯৩ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে।’