৩ বছরে সরকারের ঋণ বেড়ে হবে ২৯ লাখ কোটি

বিশেষ প্রতিবেদক
  ১৪ জুন ২০২৫, ১৩:২৪

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের গত দেড় দশকের শাসনামলে ঘোষিত বাজেট ছিল অনেকটাই ঋণনির্ভর। প্রতি বছরই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বাড়ানো হতো বাজেটের আকার। ওই সময়ে আয়ের উৎস সম্প্রসারণ না করে ঋণনির্ভর ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমেই এর আকার বড় করা হয়েছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) যে বাজেট ঘোষণা করেছেন, তাতেও ঋণনির্ভরতা কাটানোর দৃশ্যমান চেষ্টা পড়েনি। ‘ঋণ করে ঋণ শোধ’-এর যে নীতি বিগত সরকারের মেয়াদে গড়ে উঠেছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটেও তা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
জানা গেছে, বর্তমানে সরকারের ঘাড়ে চাপা ঋণের পরিমাণ প্রায় ২১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের মধ্যে সে বোঝা বেড়ে ২৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হবে বলে প্রাক্কলন করেছে সরকার। আর ২০২৬-২৭ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে ২৬ লাখ ৩ হাজার কোটি এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। ২০২৫-২৬ থেকে ২০২৭-২৮ অর্থবছরের জন্য প্রণীত মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি
বিবৃতিতে সরকারের ঋণের এই প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। সরকারি ঋণের এমন চিত্রকে উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদদের ভাষ্যমতে, ঋণ বাড়তে থাকায় সরকারের মোট পরিচালন ব্যয়ে সুদ পরিশোধের অংশ ক্রমেই বাড়ছে। ব্যয় নির্বাহ করতে সরকার এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি ব্যাংকনির্ভর হয়ে পড়ছে। সরকারের ঋণনির্ভর প্রকল্প গ্রহণের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার পাশাপাশি রাজস্ব আহরণ বাড়ানোয় মনোযোগ দেওয়া জরুরি। যেভাবে ঋণ পরিশোধের দায়দেনা বাড়ছে, তা অর্থনীতির জন্য একটি বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
প্রক্ষেপণে বলা হয়েছে, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট ঋণের স্থিতি ছিল ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। সেখানে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ঋণের এই স্থিতি বেড়ে দাঁড়াবে ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এই হিসেবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ঋণের স্থিতি বৃদ্ধি পাবে ১০ লাখ ১১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি সহায়ক খাতে ঋণ গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিলেও এটি মুদ্রার বিনিময় হার ঝুঁঁকি, ব্যয়বহুল অভ্যন্তরীণ ঋণ এবং অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার চাপের মুখোমুখি হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট রাজস্ব আহরণ আশানুরূপ না হওয়ায় সরকারের ওপর অর্থায়নের চাপ থাকছে। অন্যদিকে, উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে দেশজুড়ে ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো তৈরির প্রয়োজন।
এই প্রেক্ষাপটে, সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে একটি মধ্যমেয়াদি ঘাটতি অর্থায়ন কৌশল অনুসরণ করছে। ঘাটতি অর্থায়নের অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে ট্রেজারি বন্ড ও বিল এবং জাতীয় সঞ্চয় স্কিম প্রধান ভূমিকা পালন করছে। বৈদেশিক উৎসসমূহের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উৎস থেকে নমনীয় ও অনমনীয় ঋণ উল্লেখযোগ্য।
ঋণ স্থিতির মধ্যমেয়াদি প্রক্ষেপণ বিষয়ে বলা হয়েছে, মধ্যমেয়াদে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপির অনুপাতে স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৭-২৮ অর্থবছরের শেষে মোট ঋণ জিডিপির ৩৭ দশমিক ৭২ শতাংশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ হতে পারে জিডিপির ২১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং বৈদেশিক ঋণ হতে পারে ১৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
বিগত বছরগুলোর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের বণ্টন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশ ২০১৫ সালে নিম্নমধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। ফলে বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে অনুদান এবং নমনীয় ঋণ (কম সুদের হার, দীর্ঘ পরিশোধকাল) পাওয়ার সুবিধাদি ক্রমান্নয়ে হ্রাস পাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের ব্যয় কমিয়ে এবং বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে ঘাটতি মেটানোয় জোর দেওয়া উচিত- যাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে তুলনামূলক কম হারে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া রাজস্ব আহরণ, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ এবং ঋণ ব্যবস্থপনায় কার্যকর সংস্কার না আনা গেলে ঋণের স্থিতি ও সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে।
সূত্র: আমাদের সময়