মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে জঙ্গি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনার পর ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে চার রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় মঙ্গলবার রাতে প্রায় দুই ঘণ্টার ওই বৈঠক শেষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম-মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, “আমরা চারটা দলই বলেছি—বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এনসিপি—সবাই আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে বলেছি যে আমরা অবশ্যই সরকারের পাশে অতীতেও ছিলাম, এখনো আছি, সামনেও ইনশাআল্লাহ এই সরকারের পাশে থাকব।”
মঙ্গলবার রাত ৯টা থেকে শুরু হওয়া এ বঠকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী; জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ উপস্থিত ছিলেন।
এনসিপির পক্ষে ছিলেন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন। আর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষে গাজী আতাউর রহমান ছাড়াও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন বৈঠকে অংশ নেন।
বৈঠক শেষে বিএনপির পক্ষ থেকে কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি।
ইসলামী আন্দোলনের আতাউর রহমান বলেন, ‘দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে’ প্রধান উপদেষ্টা হঠাৎ করেই এ ‘জরুরি’ বৈঠকে তাদের আমন্ত্রণ জানান।
আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে গতকাল থেকে আজকে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তিনি (ইউনূস) বলেছেন যে পরাজিত শক্তি, বিশেষ করে ফ্যাসিবাদী শক্তির দোসররা, বিভিন্নভাবে চাচ্ছে এই পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার জন্য এবং পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যাতে দেশে একটি অস্থিরতা তৈরি করা যায়, জনমনে আতঙ্ক ছড়ানো যায়, রিউমার ছড়ানো যায়।
''মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল—যাতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য-সংহতি অটুট থাকে এবং রাজনৈতিকভাবে যাতে আগামীতে ফ্যাসিবাদী শক্তি কোনো সুযোগ নিতে না পারে। এজন্য যাতে সব ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিভেদ বা বিরোধ না থাকে।''
আতাউর রহমান বলেন, ''আমরা বলেছি, রাজনৈতিক দল হিসেবে একেক দলের একেক রকম বক্তব্য থাকবে, সমালোচনাও থাকবে। সামনে যেহেতু নির্বাচন হবে, নির্বাচনের আগে একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে সমালোচনা করবে, এটা স্বাভাবিক।
“কিন্তু আমরা একটা প্রশ্নে সবার মধ্যে একমত, সেটা হল—আওয়ামী ফ্যাসিবাদ যাতে আবার পুনর্বাসিত হতে না পারে, তারা যাতে দেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র করতে না পারে, দেশের বিরুদ্ধে কোনো রকম তৎপরতা চালাতে না পারে, এই ব্যাপারে আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি।''
সোমবার দুপুরে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত হয়। এতে ২৮ জন নিহত হয়েছেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৬৮ জন।
হতাহতের ঘটনায় ক্ষতিপূরণসহ ছয় দাবিতে মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরারকে তারা দিনভর অবরুদ্ধ করে রাখেন।
এদিকে মাইলস্টোনের ঘটনার পর মঙ্গলবারের এইচএসসি পরীক্ষা পেছানোর ঘোষণা দিতে দেরি হওয়ায় এদিন দুপুরে সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে বিক্ষোভ দেখায় কয়েকশ শিক্ষার্থী। সেখানে তারা ভাঙচুরও চালায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাঁধলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি এই আন্দোলনের পেছনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের হাত দেখতে পাওয়ার কথা বলেছে।
ইসলামী আন্দোলনও যে একই ধারণা পোষণ করছে, সে কথা তুলে ধরে আতাউর রহমান বলেন, ''আমরা একটা বিষয়ে বিশেষভাবে ইঙ্গিত করেছি, স্পষ্টভাবে, সেটা হল—বারবার আমরা দেখছি রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বাংলাদেশ সচিবালয়, যেটা সেক্রেটারিয়েট, এই সেক্রেটারিয়েট বারবার আক্রান্ত হচ্ছে।
“এটা কেন হচ্ছে? অতীতে যে সমস্ত রাজনৈতিক সরকার ছিল, তখন তো এভাবে সচিবালয় আক্রান্ত হত না। এখন এই সরকারের আমলে আমরা দেখলাম, বেশ কয়েকবার সচিবালয় অরক্ষিত। সচিবালয় এভাবে অরক্ষিত কেন থাকে? এখানে কি গোয়েন্দা ব্যর্থতা আছে? নাকি প্রশাসনিক কোনো ব্যর্থতা আছে? আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা আছে কি না—এই বিষয়টি গভীরভাবে সরকার যেন অনুসন্ধান করে দেখে, এই ব্যাপারে আমরা জোরালোভাবে কথা বলেছি।''
তিনি বলেন, ''আরেকটা বিষয় হল, আগামী জাতীয় নির্বাচন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে তো আমরা যে রাজনৈতিক দলগুলো আছি, এই সব রাজনৈতিক দলগুলোই আবার নির্বাচনে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রচারণায়, সমালোচনায় এবং ক্যাম্পেইনে মাঠে নামবে। অতএব সরকারকে তখন শুধু আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী ষড়যন্ত্র মোকাবেলা নয়, বরং আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
“এজন্য আমরা বলছি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও উন্নত করতে হবে এবং প্রশাসনিকভাবে সরকার যেন মজবুত হয়, আরও কঠোর হয় এবং সবকিছুকে কঠিনভাবে দমন করে।''
প্রশাসনে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে এখনো ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ কেউ আছে কি না খুঁজে দেখার তাগিদ দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের এই নেতা বলেন, “গোপালগঞ্জে আমরা যেটা দেখলাম, সেখানে টোটালি গোয়েন্দা ব্যর্থতা এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতা তো আছেই। এই জাতীয় ঘটনা অন্যান্য জেলায়ও সামনে ঘটতে পারে।
“এজন্য আমরা বলেছি প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। সরকারকে আরও মজবুতভাবে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে, সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে।''
আগামীতে যাতে একটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, সে ব্যাপারে বৈঠকে ‘সবাই একমত হয়েছে’ মন্তব্য করে আতাউর রহমান বলেন, “সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য আমরা সবাই একযোগে কাজ করব—এই ব্যাপারেও আমরা সবাই একমত হয়েছি।''
সংবাদ সম্মেলনে আসিফ নজরুল বলেন, যতগুলো রাজনৈতি দল আজকে কথা বলেছে সবাই একমত হয়েছে যে, ফ্যাসিবাদিরোধী প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো একমত। এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।
বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলো যে ঐক্যবদ্ধ আছে, তা দৃশ্যমান করতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।