ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ চলতি সপ্তাহের মধ্যেই স্পষ্ট হতে পারে-এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
গত শনিবার যমুনা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে ১৪টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে তৃতীয় দফা বৈঠকে তিনি এই বার্তা দেন বলে জানিয়েছেন অংশগ্রহণকারী কয়েকজন নেতা। তবে বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে নির্বাচনের নির্ধারিত দিন-তারিখ নিয়ে কিছু না থাকায় রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভ্রান্তি ও মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপি এই ইঙ্গিতকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। দলটির মতে, নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তারিখ ঘোষণার দিকেই এগোচ্ছে সরকার। তাদের আশা, প্রতিশ্রুত মতো আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে যদিও বলা হয়েছে, বৈঠকে নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি প্রধান উপদেষ্টা।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের আগে সবার মতামত নেওয়া জরুরি। তাদের মতে, বিচার ও সংস্কারের দৃশ্যমান অগ্রগতি এবং "জুলাই সনদ" ও "জুলাই ঘোষণাপত্র" বাস্তবায়নের পরই তারিখ ঘোষণা করা উচিত।
প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণ আসছে আগস্টের শুরুতেই—সম্ভবত ৫ বা ৮ আগস্ট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ভাষণে নির্বাচনের রোডম্যাপ ও প্রক্রিয়া সংক্রান্ত স্পষ্টতা আসতে পারে, যা বর্তমান অনিশ্চয়তা ও ধোঁয়াশার অবসান ঘটাবে।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, স্থিতিশীলতা এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী উদ্যোগের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে সরকার। এর মাঝেই গঠিত হয়েছে “জুলাই সনদ” প্রণয়নের উদ্যোগ ও গণহত্যা বিচারের প্রক্রিয়া।
তবে সরকারবিরোধী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা ও অনাস্থা থেকেই গেছে। গত ঈদুল আজহার প্রাক্কালে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া ভাষণে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা এলে তা প্রত্যাখ্যান করে বিএনপিসহ কয়েকটি দল। তাদের দাবি, এপ্রিল মাস নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় নয়।
পরে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও প্রধান উপদেষ্টার মধ্যে বৈঠকের পর নতুন করে ফেব্রুয়ারির সম্ভাব্য সময়সীমা আলোচনায় আসে। যদিও এখনো পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি, ফলে পুনরায় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিএনপি অভিযোগ করেছে, সরকারের ভেতর ও বাইরের কিছু মহল নির্বাচন বিলম্বে আগ্রহী।
মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ড ও ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনার পর রাজনৈতিক চাপ আরও বেড়ে যায়। এরপরই ড. ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফা বৈঠক করেন। বৈঠকে উপস্থিত জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার জানান, প্রধান উপদেষ্টা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, “চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণা করা হবে।”
সামাজিক যোগােযাগ মাধ্যমে বলছে, চলতি সপ্তাহে নির্বাচনের তারিখ কি আদৌ ঘোষণা হবে, নাকি শুধু ‘মুলা ঝোলানো’ হলো?
তার ভাষ্য অনুযায়ী, ড. ইউনূস বৈঠকের শুরুতেই বলেন, নির্বাচন বানচালের জন্য দেশে একের পর এক ষড়যন্ত্র চলছে, তবে তিনি এবং তার সরকার সেই ষড়যন্ত্র সফল হতে দেবেন না। নির্বাচনের মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হবে।
তবে বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। সেখানে বরং উল্লেখ করা হয়, পতিত শক্তি নির্বাচনী প্রক্রিয়া ভন্ডুল করতে চায় এবং সেই অপচেষ্টা রুখতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। তার পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে বোঝা যায়, তিনি তার ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন।”
এদিকে এনসিপি নেতা আখতার হোসেনের মতে, “নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কারকে দৃশ্যমান করতে হবে। এর পরেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হতে পারে।”
জামায়াতের হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, “বৈঠক নির্বাচনের জন্য হয়নি। সামগ্রিক পরিস্থিতি ও সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা নিয়ে করণীয় ঠিক করতে এই আলোচনা হয়।”
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ প্রসঙ্গে দেওয়া ইঙ্গিত নতুন আশাবাদের জন্ম দিলেও সরকারি বিবৃতিতে এই বিষয়ে স্পষ্টতা না থাকায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এই পরিস্থিতিতে বিভক্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। আগামীর নির্বাচনী রোডম্যাপ ও সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে সংশয় কাটাতে প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন ভাষণকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।