গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হলেও যেসব সংস্কার প্রস্তাবে বিভিন্ন দলের নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) আছে, সেগুলো নিয়ে মতভেদ রয়ে গেছে। আবার গণভোট আয়োজনে অধ্যাদেশ, নাকি সাংবিধানিক আদেশ জারি করা হবে– এ নিয়েও আছে মতভিন্নতা।
প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন বলছে, নোট অব ডিসেন্ট নয়, গণভোট হবে জুলাই সনদের ওপর। গণভোটে জনগণকে প্রশ্ন করা হবে, তারা জুলাই সনদ অনুমোদন করবে কিনা? তবে বিএনপি বলছে, নোট অব ডিসেন্ট জুলাই সনদের অংশ। যে দলের যে সংস্কারে ভিন্নমত আছে, তারা সংসদ নির্বাচনে জয়ী হলে সেগুলো কার্যকরের বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এমন বিধান রেখেই গণভোট হতে হবে।
জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দলের অবস্থান– জুলাই সনদে থাকা ৮৪ প্রস্তাবকে একটি প্যাকেজ বিবেচনা করে গণভোট হতে হবে। জনগণ সনদ অনুমোদন করলেও উচ্চকক্ষে পিআরসহ সব সংস্কার কার্যকরে বাধ্য থাকবে পরবর্তী সংসদ।
বিএনপির মতো এনসিপিও সংসদ নির্বাচনের দিনে গণভোট আয়োজনে রাজি। বিএনপি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে গণভোট আয়োজনের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দিতে চায়। তবে এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন জামায়াতের মতো সাংবিধানিক আদেশে সনদ কার্যকর চায় নির্বাচনের আগে। জামায়াত গণভোটও নির্বাচনের আগে চায়। জামায়াত গণভোটের সময় নিয়ে আলোচনায় আগ্রহ দেখালেও এনসিপির মতো এ দলটির অবস্থান হলো অন্তত উচ্চকক্ষে পিআর হতেই হবে।
নোট অব ডিসেন্ট জটিলতা
জুলাই সনদের খসড়া আগেই চূড়ান্ত করেছে ঐকমত্য কমিশন। সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তের ৭৩টিতে প্রায় সব দলের ঐকমত্য রয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে না থাকা, রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া, প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত কমিটির মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগসহ ৯টি সিদ্ধান্তে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। দলটি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে একমত হলেও প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে র্যাঙ্ক চয়েজ ভোটে রাজি হয়নি। তবে সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০ দল ও জোটের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি এসব সংস্কারে একমত হওয়ায় কমিশন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত দেয়।
বিএনপির অবস্থান– যে দল যে সংস্কারে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, তারা তা নির্বাচনী ইশতেহারে রাখবে। নির্বাচনে জয়ী হলে সেগুলো বাস্তবায়ন না করার এখতিয়ার তাদের থাকবে।
জামায়াত ও এনসিপি বলছে, নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার সময় জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি হিসেবে গণভোট আলোচনায় ছিল না। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, যখন সব দলের ঐকমত্য হচ্ছিল না, তখন জামায়াত প্রস্তাব করেছিল গণভোট হোক। এখন যেহেতু গণভোটের সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাই কোন দল কী নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, তা আর বিবেচ্য নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হওয়ায় নোট অব ডিসেন্ট মানা বাধ্যতামূলক নয়।
একই রকম অভিমত জানিয়ে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, নোট অব ডিসেন্ট মানেই হচ্ছে ভিন্নমত থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া। গণভোট হবে জুলাই সনদের ওপর। একটি বা দুটি দলের ভিন্নমতের চেয়ে জনগণের অভিপ্রায় অনেক ঊর্ধ্বে। গণভোটের ফলাফল অনুযায়ী সংস্কার বাস্তবায়নে সবাই বাধ্য।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এসব বক্তব্যকে খণ্ডন করেছেন। তিনি বলেন, নোট অব ডিসেন্ট এখন জুলাই সনদেরই অংশ। গণভোট হবে সনদের ওপর। সেখানে লেখা থাকবে, কোন দলের কোন বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। ফলে জনগণ তা জেনেই আগামী সংসদকে সনদ বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেবে। যে দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, তাদের এখতিয়ার থাকবে নোট অব ডিসেন্ট অনুযায়ী সংস্কারের।
তবে ঐকমত্য কমিশনের অবস্থান ভিন্ন। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সমকালকে বলেন, ‘গণভোটে ভিন্নমত নয়, প্রশ্ন থাকবে– জনগণ জুলাই সনদ অনুমোদন করে কিনা। অতীতে যেসব গণভোট হয়েছে, সেখানে ব্যালটে একটি প্রশ্নই রাখা হয়েছিল। যেমন– তুরস্কের ২০১৭ সালের গণভোটে সংবিধানের ৮৮টি পরিবর্তন আনা হয়েছে। গণভোটে প্রতিটি পরিবর্তন বিষয়ে মতামত গ্রহণ করা হয়নি। ব্যালটে প্রশ্ন ছিল, তারা সংবিধানের পরিবর্তনে একমত কিনা?’
কমিশনের সহসভাপতি জানিয়েছেন, গণভোট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে আজ মঙ্গলবার আলোচনা হবে। বুধবার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছিল, সংবিধান আদেশ জারি করে তারপর গণভোট করা এবং আগামী সংসদকে গণপরিষদ বিবেচনা করে সেখানে সংস্কারের পর গণভোট করা।
জিয়াউর রহমানের উদাহরণ জামায়াতের
১৯৭৭ সালের ৩০ মে, ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ এবং ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দেশে গণভোট হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৭ সালের গণভোট নিয়ে উদাহরণ দিচ্ছে জামায়াত। সেবার ব্যালটে প্রশ্ন ছিল, ‘আপনি কি রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের (বীরউত্তম) প্রতি এবং তাঁর দ্বারা গৃহীত নীতি ও কার্যক্রমের প্রতি আস্থাশীল?’ ভোটারদের ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ ভোট দিতে বলা হয়। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল সংসদে পাসের পর তা গণভোটে দেওয়া হয়।
হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের ১৯ দফার বিষয়ে ব্যালটে কি আলাদা প্রশ্ন ছিল? না। রাষ্ট্রপতির সব নীতি ও কার্যক্রম বিষয়ে প্যাকেজ আকারে মতামত চাওয়া হয়। ৯১-এ দ্বাদশ সংশোধনীতে সংবিধানে ২২টি পরিবর্তন আনা হয়। গণভোটে প্রতিটি বিষয়ে আলাদা প্রশ্ন করা হয়নি। জিজ্ঞাসা করা হয়নি– জনগণ রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা, নাকি সংসদীয় গণতন্ত্র চায়। প্রশ্ন ছিল– জনগণ সংসদীয় গণতন্ত্র চায়, কি চায় না। এবারও তেমন প্রশ্ন থাকবে– জনগণ জুলাই সনদ চায়, কি চায় না।
সালাহউদ্দিন আহমেদ এই বক্তব্যও নাকচ করেছেন। তিনি বলেন, সাতাত্তরের গণভোট এবারের চেয়ে ভিন্ন ছিল। তখন জনগণের কাছে রাষ্ট্রপতির পদে থাকা এবং তাঁর কার্যক্রম বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। এবার তো নীতিগত বা কার্যক্রমের কোনো বিষয় নেই। আবার একানব্বইয়ের সঙ্গেও এটা মিলবে না। তখন যে পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছিল, সবই ছিল সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য। সেগুলো করা হয়েছিল সংসদে। এবার তো সংসদ নেই। আগামী সংসদে সংস্কার হবে। গণভোট হবে সংস্কার বিষয়ে বাধ্যতাবাধকতা তৈরির জন্য। যাতে আইনি বিতর্ক না থাকে।
সাংবিধানিক আদেশ, নাকি অধ্যাদেশ
বিএনপি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এবং জামায়াত সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে গণভোট আয়োজনের কথা বলছে। দুটি পদ্ধতি নিয়ে কমিশন আলোচনা করছে। কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একজন সদস্য বলেন, অধ্যাদেশ জারির এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের রয়েছে। সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আগামী সংসদ গঠনের ৩০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের জারি করা অধ্যাদেশগুলো অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করতে হবে। ফলে অধ্যাদেশের মাধ্যমে গণভোট হলে আগামী সংসদে ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে ফয়সালা হয়ে যাবে, যা অধ্যাদেশের ভালো দিক।
অধ্যাদেশের দুর্বল দিক হলো, ৩০ দিনের মধ্যে তা সংসদে উত্থাপন করা না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সব বাতিল হয়ে যাবে। ফলে অধ্যাদেশের মাধ্যমে গণভোট করলে আগামী সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অনুমোদনের জন্য উত্থাপন না করলে পুরো সংস্কারই ভেস্তে যাবে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এ বিবেচনায় সাংবিধানিক আদেশই ভালো সমাধান। কিন্তু এই আদেশ জারির ক্ষমতা এবং এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের আছে কিনা– এ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যে ভিন্নতা আছে।
বিশেষজ্ঞ, জামায়াত এবং এনসিপি সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে সনদ কার্যকরের পর গণভোটের পক্ষে। বিএনপি মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক আদেশ জারির ক্ষমতা নেই।
রোববারের সংলাপে জামায়াতের প্রতিনিধি শিশির মনির বলেন, শুধু জনগণের কনস্টিটুয়েন্ট পাওয়ার (সংবিধান প্রণয়ন বা রহিতের ক্ষমতা) এবং অ্যামেন্ডমেন্ট পাওয়ার (সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা) রয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গঠিত সরকারকে জনগণ এই দুই ক্ষমতা দিয়েছে। এই ক্ষমতাবলে সরকারের সাংবিধানিক আদেশ জারির ক্ষমতা রয়েছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের কনস্টিটুয়েন্ট এবং অ্যামেন্ডমেন্ট পাওয়ার নেই। ফলে সংবিধান আদেশ জারির ক্ষমতা নেই। এই ক্ষমতা থাকলে সরকার রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যের জন্য ডাকত না।
আলী রীয়াজ বলেন, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের সাংবিধানিক আদেশ জারির ক্ষমতা রয়েছে। তবে এ বিষয়ে বুধবার আলোচনা হবে।
সূত্র: সমকাল