ধ্বংস করা হচ্ছে বাংলার ঐতিহ্য

ময়মনসিংহে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ ভাস্কর্য ভাঙচুর

কুমিল্লায় বীরচন্দ্র পাঠাগারে ভাঙচুর-লুট, পোড়াল হাজারও বই
ডেস্ক রিপোর্ট
  ০৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:৩১

ময়মনসিংহ নগরে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়েছে। ভাস্কর্যটির নাক-মুখ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর শোনার পর ময়মনসিংহ নগরে আনন্দ মিছিল বের হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় এক দল লোক ভাস্কর্যটি ভাঙচুর করে।
ময়মনসিংহ নগরের কাঁচিঝুলি এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। সংগ্রহশালার সামনে জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ ভাস্কর্যটি ২০১৫ সালে নির্মাণ করে তৎকালীন ময়মনসিংহ পৌরসভা। ভাস্কর্যটির এক পাশে সংগ্রহশালা, অন্য পাশে উদ্যান।
জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার উপকিপার মুকুল দত্ত বলেন, সোমবার সন্ধ্যার আগমুহূর্তে একদল লোক অটোরিকশা দিয়ে এসে ভাস্কর্যটি ভাঙতে শুরু করে। তখন আনন্দ মিছিল থেকে ছড়িয়ে থাকা অনেক শিক্ষার্থীও এলাকাটিতে ছিল। সংগ্রহশালার কর্মী ও উপস্থিত কিছু শিক্ষার্থী বিক্ষুব্ধ লোকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, জয়নুল আবেদিন কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি নন। এরপর ভাঙচুর বন্ধ করে তারা চলে যায়।
মুকুল দত্ত আরও বলেন, ভাস্কর্যটি সংস্কারের জন্য কয়েকজন শিল্পী এসে দেখে গেছেন। এটি নির্মাণ করেছিল তৎকালীন পৌরসভা। তাই বিষয়টি সিটি করপোরেশনকে জানানো হয়েছে।
ভাস্কর্যটি সংস্কারের জন্য কয়েকজন শিল্পী এসে দেখে গেছেন। এটি নির্মাণ করেছিল তৎকালীন পৌরসভা। তাই বিষয়টি সিটি করপোরেশনকে জানানো হয়েছে।
গতকাল বুধবার বিকেলে সংগ্রহশালার সামনে গিয়ে দেখা যায়, ভাস্কর্যটির নাক-মুখ ভাঙা। নিচে পড়ে আছে কিছু টুকরো। উদ্যানে আসা দর্শনার্থীরা ভাস্কর্যটির এমন অবস্থা দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ময়মনসিংহ মহানগর সুজনের সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন বলেন, ময়মনসিংহ নামের সঙ্গে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নাম চলে আসে। শিল্প-সংস্কৃতির এই শহরে শিল্পাচার্যের ভাস্কর্যটির যা করা হয়েছে, তার মোটেই কাম্য নয়। এ ধরনের অপতৎপরতা যারা করেছে, তাদের ভেতরে শিল্পবোধ নেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ভাস্কর্য সংস্কার করার উদ্যোগে নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা ছাত্র ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ময়মনসিংহের সমন্বয়ক আলী হোসেন। তিনি বলেন, ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্যটি বিকৃত করে দেওয়া কোনোভাবেই কামনা করিনি। কখনো ভাবতে পরিনি এমনটি ঘটবে। কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তি এটি করে থাকতে পারে। কোনো শিক্ষার্থী এর সঙ্গে জড়িত নয়।
জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিভাবান এই শিল্পীকে ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্প আন্দোলনের পথিকৃৎ বলে ধরে নেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট) তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ।
১৯৭৫ সালে জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁয়ে একটি লোকশিল্প জাদুঘর এবং ময়মনসিংহে একটি গ্যালারি (শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা) প্রতিষ্ঠা করেন। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে তাঁর অঙ্কিত কিছু চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে। ফুসফুসে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়।

কুমিল্লায় বীরচন্দ্র পাঠাগারে ভাঙচুর-লুট, আগুনে পুড়িয়েছে পুড়ে হাজারও বই
কুমিল্লার বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনে (টাউন হল) হামলা হয়েছে। সেখানে বইপত্র লুট ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বিজয় মিছিল থেকে সেখানে হামলা করা হয়।
গত সোমবার দুপুরের পর কুমিল্লা শহরে বিজয় মিছিল বের করা হয়। নগরের কান্দিরপাড়ে উল্লাসে মেতে উঠে লোকজন। তখন একদল বিক্ষুব্ধ লোক বীরচন্দ্র গণপাঠাগারের প্রবেশ করে। প্রথমে তাঁরা কেয়ারটেকারের কক্ষে প্রবেশ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেখানে কিছু বই পুড়ে যায়। পরে মুক্তিযোদ্ধা কর্নার করা হয়। পরে লোকজন দ্বিতীয় তলায় প্রবেশ করে ভাঙচুর করে। লুট করে নিয়ে যায় অনেক বই। এসব বইয়ের অনেকগুলো অন্তত দুই শ বছর আগে মুদ্রণ করা হয়েছিল।
বীরচন্দ্র গণপাঠাগারের কেয়ারটেকার রঞ্জিত জানান, গত সোমবার দুপুরে তিনি দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য বাইরে যান। তারপর শোনেন পাঠাগারে হামলা হয়েছে। আগুনে তাঁর কক্ষ পুড়ে গেছে। অনেক বইও পুড়ে গেছে।
আজ বুধবার বেলা ১১টায় বীরচন্দ্র গণপাঠাগারে গিয়ে দেখা যায়, কেয়ারটেকারের কক্ষে ধোঁয়া বের হচ্ছে। দোতলায় সব কটি আলমারি ভেঙে পড়ে আছে। অনেক ম্যাগাজিন ও বেশ কিছু বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেঝেতে কাচের টুকরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
ওই ঘটনার পর পাঠাগারের সদস্যসহ গণমান্য ব্যক্তিরা সেখানে যাচ্ছেন। শাহ মোহাম্মদ সেলিম জানান, ‘বইগুলো আমাদের কুমিল্লার সম্পদ। এগুলো যাঁরা নিয়েছেন, তাঁরা যেন স্ব-উদ্যাগে লাইব্রেরিতে ফিরিয়ে দেন।’ একই দাবি জানান বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবদুর রাজ্জাক।
পাঠাগারের লুট করা বই ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, লালমাই কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান, সিপিবি নেতা শেখ আবদুল মান্নান, বিকাশ চন্দ্র দেব, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব খায়রুল আনাম রায়হান, ঐতিহ্য কুমিল্লার প্রতিষ্ঠাতা জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ।
লেখক ও গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, এখানে ১০০ বছর আগের বই আছে পাঁচ হাজারের বেশি। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকার প্রথম সংখ্যা থেকে প্রায় সব কটি সংখ্যাই ছিল। এখানে মহাকবি ফেরদৌসির রচিত শাহানামার প্রথম সংস্কারণের কপি আছে। আধি রাজমালার প্রথম সংস্করণেরও কপি আছে। অনেকগুলো পুঁথি আছে। এ গুলো শুধু কুমিল্লার জন্য নয়, সমগ্র বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। বইগুলো যাঁরা লুট করেছেন, তাঁরা যেন দয়া করে বইগুলো ফিরিয়ে দেন।