প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ ৬ বিচারপতির পদত্যাগ

নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ
ডেস্ক রিপোর্ট
  ১০ আগস্ট ২০২৪, ২৩:১৯
প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পাঁচ দিনের মাথায় গতকাল শনিবার বিকালে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন ওবায়দুল হাসান। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক ভিডিও লাইভে এ তথ্য জানান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন ও বিচার উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। পরে পদত্যাগ করেন আপিল বিভাগের আরও পাঁচ বিচারপতি। ওবায়দুল হাসানের স্থলে নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ : গতকাল রাতে ৬৫ বছর বয়সী সৈয়দ রেফাত আহমেদকে দেশের ২৫তম 
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সৈয়দ রেফাত আহমেদ হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি। নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়Ñ সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদে দেওয়া ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এই নিয়োগ শপথের তারিখ থেকে কার্যকর হবে।
বঙ্গভবন সূত্রে জানা যায়, আজ রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় বঙ্গভবনের দরবার হলে রাষ্ট্রপতি নতুন বিচারপতির শপথ পড়াবেন। সৈয়দ রেফাত আহমেদ প্রখ্যাত আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের ছেলে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রিধারী বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ১৯৮৪ সালে জেলা জজ আদালতের একজন আইনজীবী হিসেবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে তালিকাভুক্ত হন। এরপর ১৯৮৬ সালে হাইকোর্ট বিভাগে এবং ২০০২ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। পরে ২০০৩ সালের ২৭ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এর ২ বছর পর ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি একই বিভাগে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োজিত হন। আগামী বছরের ২৭ ডিসেম্বর তার ৬৭ বছর পূর্ণ হবে।
সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ : গতকাল সকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ফেসবুকে এক পোস্টে অবিলম্বে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে সুপ্রিমকোর্ট ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেন। পরে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শিক্ষার্থীরা সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হতে থাকেন। প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে সুপ্রিমকোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। সেখানে তারা প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিতে নানা সেøাগান দেন।
এর আগে প্রধান বিচারপতি গতকাল সকালে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের নিয়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমে ফুলকোর্ট সভার আহŸান করলেও আন্দোলনকারীরা ঘেরাওয়ের ডাক দেওয়ার পর তা স্থগিত করা হয়। ফুলকোর্ট সভা আহŸানের পরপরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক, বর্তমানে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভ‚ঁইয়া ফেসবুক পোস্টে লিখেনÑ ‘ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট ও নানান অপকর্মে জড়িত সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি সরকারের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা না করে ফুলকোর্ট মিটিং ডেকেছেন। পরাজিত শক্তির যে কোনো প্রকার ষড়যন্ত্র বরদাশত করা হবে না। আইনজীবীরা এরই মধ্যে এর প্রতিবাদে জড়ো হয়েছেন। আমরা আগেই প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগের আহŸান জানিয়েছিলাম। ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের উসকানি দিলে এর ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হবে। অনবিলম্বে বিনা শর্তে প্রধান বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করুন এবং ফুল কোর্ট মিটিং বন্ধ করুন।’
এদিকে একই সময় একদল আইনজীবী সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সমিতির সামনে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের পদত্যাগে একই দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন। শিক্ষার্থী এবং আইনজীবীদের বিক্ষোভের মধ্যে দুপুর দেড়টার দিকে খবর আসে, প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ সংবাদ প্রকাশ হলে দুপুর ২টার দিকে আন্দোলনকারীরা আদালত এলাকা ছেড়ে চলে যান। এরপর বিকালে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আইন মন্ত্রণালয়ে তার পদত্যাগপত্র পাঠান।
আরও পাঁচ বিচারপতির পদত্যাগ : এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে প্রধান বিচারপতির পাশাপাশি আপিল বিভাগের আরও পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। গতকাল সন্ধ্যায় আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর তারা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়।
পদত্যাগ করা পাঁচ বিচারপতি হলেনÑ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন। তবে আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতিসহ সাত বিচারপতির মধ্যে বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম পদত্যাগ করেছেন কিনা, তা জানা যায়নি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা আপিল বিভাগের সব বিচারপতির পদত্যাগের দাবি জানান।


ওবায়দুল হাসান আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেনÑ আইন উপদেষ্টা : এদিকে বিকালে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা শেষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্টে প্রধান বিচারপতি একটি ফুলকোর্ট মিটিং ডেকেছিলেন। আরেকটি বিষয় ছিল খুব দুঃখজনক, তিনি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর ছাত্রলীগের কাছ থেকে ফুলের শুভেচ্ছা নিয়েছিলেন। এটা আমার কাছে মনে হয়েছে আচরণবিধি লঙ্ঘন। এ ছাড়া ডিবির তৎকালীন কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে মন্তব্য করে আসিফ নজরুল বলেন, প্রধান বিচারপতি তার (ডিবির হারুন) কাছ থেকেও স্বর্ণের তরবারি উপহার নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা বিদেশে গেলে তার (প্রধান বিচারপতির) বাসায় থাকেন। এসব বিষয়ে তো তাকে নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল।
এক সময় একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকের দায়িত্ব পালন করা বিচারপতি ওবায়দুল হাসান দেশের চতুর্বিংশতিতম প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে আসেন গত বছরের সেপ্টেম্বরে। সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী, বয়স ৬৭ বছর পূর্ণ হলে ২০২৬ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত তার বিচার অঙ্গনের নেতৃত্বে থাকার কথা ছিল। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের যে দাবি উঠেছে, তার ধাক্কায় মেয়াদ পূর্তির দেড় বছর আগেই প্রধান বিচারপতিকে সরে যেতে হলো।
মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন ওবায়দুল হাসান : হাইকোর্টে দায়িত্ব পালন কালে ২০১২ সালের ২৩ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারক হিসেবে যোগ দেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই সময়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে ১১টি যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় আসে।
২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ইসি নিয়োগের সর্বশেষ সার্চ কমিটির প্রধান ছিলেন। ১৯৫৯ সালের ১১ জানুয়ারি নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার ছয়াশী (হাটনাইয়া) গ্রামে ওবায়দুল হাসানের জন্ম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পর আইনে লেখাপড়া করেন ওবায়দুল হাসান। এলএলবি শেষ করে ১৯৮৬ সালে তিনি আইনজীবী হিসেবে জেলা বারের তালিকাভুক্ত হন। পরে ১৯৮৮ সালে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এবং ২০০৫ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ওবায়দুল হাসান। সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ডেপুটি এটর্নি জেনারেল হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০০৯ সালের ৩০ জুন অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে যোগ দেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তার ভাই সাজ্জাদুল হাসান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের নেত্রকোণা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ছিলেন।