পুরান ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার কা-ে দেশজুড়ে চলছে তোলপাড়। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত এ দুই আসামি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য। আদালতপাড়া থেকে তাদের কেড়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল প্রায় এক বছর আগে। এরই ধারাবাহিকতায় সাত মাস আগে ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে কেনা হয় মোটরসাইকেল। এ পরিকল্পনার মূলহোতা ছিলেন আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া। তার করা ছক ধরে পুরান ঢাকার আদালতপাড়ায় দফায় দফায় র্যাকি করে জঙ্গিরা। অপারেশনে অংশ নেওয়া জঙ্গিদের টিমটিকে সাজানো হয় তারই দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী।
কখন, কীভাবে হামলা চালাতে হবে; হামলার পর কোন পথে পালাতে হবে সেই ছকও করে দিয়েছিলেন মার্কিন সরকারের মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় থাকা মেজর জিয়া। এই ছক করার জন্য কারাবন্দি জঙ্গিদের সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগও করেন তিনি একটি গোপন অ্যাপসের মাধ্যমে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার বাইরেও একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্রের খবর, জিয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আনসার আল ইসলামের ২০ সদস্যের অপারেশনাল টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। অপারেশনে তাদের কার কী ভূমিকা হবে, তাও নির্ধারণ করে দেন জিয়া নিজেই।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, আনসার আল ইসলামের প্রধান সৈয়দ জিয়াউল হকের পরিকল্পনায় ১৮ সহযোগী মিলে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার অপারেশনে নামে। পুলিশ ঘটনাস্থল এবং আশপাশের এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করছে। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় ২০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ২০ থেকে ২১ জনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আদালতে আসা ১২ জঙ্গির মধ্যে দুজনকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকি ১০ জনকে ১০ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পলাতক দুই জঙ্গিকে ধরতে অভিযান চলছে। যে কোনো মুহূর্তে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। কোতোয়ালি থানায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটে (সিটিটিসি)।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কারাগার থেকে আদালত পর্যন্ত আসামিদের যাতায়াতের পুরো পথই একাধিকবার রেকি করেছিল জঙ্গিরা। তুলনামূলক কম নিরাপত্তা থাকার কারণে সিদ্ধান্ত হয় আদালত এলাকাতেই চালানো হবে সহযোগীদের ছিনিয়ে নেওয়ার অপারেশন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী রবিবার সকাল থেকেই আদালত এলাকায় অবস্থান নেয় জঙ্গি দলের সদস্যরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী শুনানি শেষে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত চারজনকে প্রথমে নিচে নামানোর সুযোগ করে দেয় তাদের অপর সহযোগীরা।
রিমান্ডে থাকা আরাফাত ও সবুরকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সিটিটিসির একটি সূত্র জানান, ত্রিশালে যেভাবে জঙ্গি ছিনতাইয়ের অপারেশন হয়েছিল, সেভাবে অর্থাৎ প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু কাশিমপুর থেকে ঢাকার আদালতে আনা-নেওয়ার সময় প্রিজনভ্যানে হামলা করাটা অনেক বেশি ঝুঁঁকিপূর্ণ এবং অনেক বেশি শক্তিরও প্রয়োজন। এ জন্য শেষ পর্যন্ত আদালতপাড়াকে টার্গেট করা হয়।
সিটিটিসির এক কর্মকর্তা জানান, ফাঁসির আসামিরা কারাগারের ভেতরে কনডেমড সেলে থাকে। সেখানেই তারা হরহামেশা মোবাইল ফোন ব্যবহার করত। জিজ্ঞাসাবাদে তারা সেটা স্বীকারও করেছে। কারাগারের বাইরে তাদের যেসব নেতা আছে, তাদের সঙ্গে যৌথ পরিকল্পনার মাধ্যমে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়। এ জন্য রিমান্ডে আনা ১০ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের অন্য জঙ্গিদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, গতকাল সিটিটিসি প্রধান ডিআইজি আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে একাধিক দল কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে যায়। প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে দলটি বের করার চেষ্টা করে, কারাগার থেকে কার মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে জঙ্গিরা বাইরের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তারা জঙ্গি ছিনতাইয়ে নেতৃত্ব দেওয়া জঙ্গিকেও শনাক্ত করেছেন। তাকে ধরতে ইতোমধ্যে অভিযানও শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, গত রবিবার ঢাকার আদালত থেকে পালিয়ে যাওয়া মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই আসামি সিফাত সামির ও সোহেল ওরফে সাকিব আনসার আল ইসলামের আশকারি সদস্য। তারা জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি। আনসার আল ইসলামের নেতা মেজর জিয়ার পরিকল্পনা ও দিক-নির্দেশনায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একাধিক লেখক, প্রকাশক, ব্লগার ও সমকামী অধিকারকর্মীকে হত্যা করে সংগঠনটির সদস্যরা। মেজর জিয়াকে ধরতে কয়েক বছর আগেই পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। আর মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের জেরে মার্কিন সরকার গত বছর মেজর জিয়াকে ধরতে ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে।
সর্বশেষ, দুই জঙ্গি পালিয়ে যাওয়ার মামলায় সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, সাংগঠনিক শক্তি জানান দিতে এবং আগামীতে আরও বড় ধরনের হামলা চালাতেই জঙ্গি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে তারা তথ্য পেয়েছেন। টার্গেট ছিল, ৪ জঙ্গিকেই ছিনিয়ে নেওয়ার। আদালতে হাজিরার জন্য আসা অন্য ৮ জঙ্গিরও যোগসাজশ ছিল এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। ছিনতাইকাণ্ডে অংশ নেওয়া জঙ্গিরা ছিল অস্ত্রধারী। কিন্তু দুই জঙ্গিকে খুব সহজেই কেড়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে বলে তারা অস্ত্রের ব্যবহার করেনি।
নসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া
রিমান্ডের আসামিরা হচ্ছে- শাহিন আলম, শাহ আলম, বিএম মজিবুর রহমান, সুমন হোসেন পাটোয়ারী, খায়রুল ইসলাম, মোজাম্মেল হোসেন, আরাফাত রহমান, শেখ আব্দুল্লাহ, আব্দুস সবুর ও রশিদুন্নবী। এ দশজনের মধ্যে আরাফাত ও সবুরকেও ছিনিয়ে নেওয়ার টার্গেট ছিল জঙ্গিদের। সেভাবে চেষ্টাও করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
২ জঙ্গি ছিনতাইকাণ্ডে যে মামলা হয়েছে, তার এজাহারে বলা হয়- আনসার আল ইসলামের শীর্ষ নেতা সেনাবাহিনীর বরখাস্ত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের নির্দেশে জঙ্গিরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে আসামিদের ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী দুটি মোটরসাইকেলে অজ্ঞাতনামা ৫/৬ জন সদস্য অবস্থান নেয়। এছাড়া আরও ১০/১২ জন আনসার আল ইসলামের সদস্য আদালতের মূল ফটকের সামনে অবস্থান করে। এরপর তারা পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা বাধা দিলে আসামিদের একজন লোহা কাটার যন্ত্র দিয়ে একজন কনস্টেবলের মুখে আঘাত করা হয়।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তি ও তার কয়েকজন সহযোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের জঙ্গি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনাও জানতে পেরেছে পুলিশ। তাদের সবাইকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার কাজ চলছে।
জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, কারা কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল দুর্ধর্ষ আসামিদের ডা-াবেড়ি পরিয়ে আদালতে পঠানো। প্রসিকিউশন পুলিশকে অবহিত করলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া যেত।
সাময়িক বরখাস্ত ৫ পুলিশ : ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সাময়িক বরখাস্তরা হলেন- সিএমএম আদালতের হাজতখানার কোর্ট ইন্সপেক্টর মতিউর রহমান, হাজতখানার ইনচার্জ এসআই নাহিদুর রহমান, আসামিদের আদালতে নেওয়ার দায়িত্বে থাকা পুলিশের এটিএসআই মহিউদ্দিন, কনস্টেবল শরিফুল হাসান ও কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার। মহানগর পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার জসীম উদ্দীন বলেন, আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনায় পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ বিষয় তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন হবে।
অনলাইন থেকে কেনা হয় মোটরসাইকেল : জঙ্গিদের ছিনিয়ে নিতে দুটি মোটরসাইকেলে এসেছিল সহযোগীরা। পালানোর সময় ফেলে যাওয়া মোটরসাইকেলটি সাত মাস আগে অনলাইন থেকে কিনেছিল জঙ্গিরা। জানা গেছে, ঢাকা মেট্রো-ল-৩১-৫৭১০ নম্বরের মোটরসাইকেলটি হাসান আল মামুন নামে এক যুবকের নামে নিবন্ধন করা। অনলাইনের মাধ্যমে তিনি মোটরসাইকেলটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। ছিনতাইয়ের পরিকল্পনায় জঙ্গিরা অনলাইন থেকে কিনে কৌশলের অংশ হিসেবে মোটরসাইকেলটি কিনে নিবন্ধন পরিবর্তন করেনি।
তদন্তে পুলিশ সদর দপ্তরের কমিটি : জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এ কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. মনজুর রহমান। পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অডিট) মো. আমিনুল ইসলামকে তদন্ত কমিটির প্রধান আর অতিরিক্ত ডিআইজি মো. হাসানুজ্জামানকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। অপর দুই সদস্য হলেন- সিটিটিসির যুগ্ম কমিশনার এএইচএম কামরুজ্জামান ও সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আনিচুর রহমান। এর আগে ঘটনা তদন্তে রবিবার পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে ঢাকা মহানগর পুলিশ। ওই কমিটিকেও তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামের আদালতে নিরাপত্তা জোরদার, কারাগারে নজরদারি বৃদ্ধি : চট্টগ্রাম ব্যুরোর পাঠানো খবরে বলা হয়, ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে এবং আশপাশের জনবহুল স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ চোখে পড়েছে। এদিন কাউকে সন্দেহ হলেই তল্লাশি চালায় পুলিশ। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (জনসংযোগ) পংকজ দত্ত বলেন, সব সময় আদালত এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ থাকে। তবে ঢাকার ঘটনার পর চট্টগ্রাম আদালত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তিনি জানান, কারাবন্দি জঙ্গিদের আদালতে আনা-নেওয়ার দিন পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন থাকে। এর পরও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও বাড়ানো হবে, বলেন তিনি।
এদিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার মো. গিয়াসউদ্দিন জানিয়েছেন, দুই জঙ্গি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় কারাগারে নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তিনি জানান, কারাগারটিতে বন্দিদের মধ্যে জঙ্গি আছে ৪২ জন। অন্য বন্দিদের থেকে তাদের পৃথক রাখা হয়। এ ছাড়া সব সময়ই তাদের ওপর বিশেষ নজরদারি থাকে।