আগামী ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে বিএনপির গণসমাবেশ সামনে রেখে ঢাকায় সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। এ অভিযানে বিএনপি-জামায়াতের কেন্দ্রীয়, মহানগর এবং থানা-ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের তালিকা ধরে ধরপাকড় চালানো হচ্ছে।
গত এক মাস ধরে তথ্য প্রযুক্তি, স্থানীয় সোর্স ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সহযোগিতায় অভিযানের জন্য এ তিন শ্রেণির তালিকা তৈরি করা হয়। সেই তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হয় মাঠ পুলিশের হাতে। তবে অভিযানে গিয়ে বেশিরভাগ ঠিকানাতেই বিএনপি-জামায়াত নেতাদের পুলিশ পাচ্ছে না। বিশেষ করে যাদের বিরুদ্ধে নাশকতার একাধিক মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোনায়ানা রয়েছে, তাদের সবাই পলাতক রয়েছেন।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে রাজধানীতে বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে। জ¦ালাও-পোড়াও ভাঙচুরসহ যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে নগরবাসীর জানমাল রক্ষায় তারা অভিযান শুরু করেছেন।
বিএনপি নেতারা বলছেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ ঠেকাতে ইতোমধ্যেই তাদের নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার শুরু করেছে পুলিশ। গত তিন দিনে সারাদেশে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের ৭৭৬ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই সবচেয়ে বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের বাসায় পুলিশ হানা দিচ্ছে। কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই তাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল শনিবার বলেছেন, বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের জায়গা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। এখন তারা পল্টনে সমাবেশ করতে চাচ্ছে। ঢাকার আইনশৃঙ্খলা ও ঢাকাকে সচল রাখার জন্য ডিএমপি কমিশনার যা যা করণীয়, এখন তিনি তাই করবেন।
ডিএমপির ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ সামনে রেখে বিএনপি ও জামায়াতের ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের হালনাগাদ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পুরনো রাজনৈতিক মামলার পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরেই অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে শনিবার রাত থেকে গ্রেপ্তার অভিযান জোরদার করা হয়। বিশেষ করে নাশকতার মামলার আসামি ও জামিনে ছাড়া পাওয়া বিএনপি-জামায়াতের ‘হিটার’ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের জায়গা দেওয়া হয়েছে। তাদের সেখানেই সমাবেশ করতে হবে। আর তারা যদি জোর করে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চায়, তা হলে তাদের সেটা বেআইনি সমাবেশ হবে। আর একটি বেআইনি সমাবেশের বিষয়ে পুলিশের যে আইনি ব্যবস্থা আছে, সেই আইনি ব্যবস্থাই নেওয়া হবে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে তিনি বলেন, পুলিশ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে। কোনো রাজনৈতিক গ্রেপ্তার হচ্ছে না। অপরাধীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ নিয়মিত কাজ করছে। সেই কাজের অংশ হিসেবেই অপরাধীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে।
ডিএমপির একটি থানার ওসি বলেন, গত শুক্রবার রাতে অভিযানে তারা যুবদলের দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করেছেন। বুধবার গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপি ও ছাত্রদলের ছয় নেতাকর্মীকে। ডিএমপি সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী রাজনৈতিক মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ বলেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে, আমরা তাদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছি। কাউকে হয়রানি করার জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর পুলিশ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের যে হালনাগাদ তালিকা করেছে, তা ডিএমপির ক্রাইম বিভাগের সব জোনের পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে। সেই তালিকা ধরেই এখন দায়িত্বপ্রাপ্ত টিমগুলো অভিযানে রয়েছে। ১০ ডিসেম্বর সামনে রেখে এখন গোয়েন্দা পুলিশের নিয়মিত ‘ক্রাইম ওয়ার্কে’ গুরুত্ব না দিয়ে রাজনৈতিক মামলার আসামিদের ধরপাকড়ে মাঠে নামানো হয়েছে। একই রূপে আবির্ভূত হয়েছে ডিএমপির বেশিরভাগ থানা পুলিশ।
রাজধানীতে বিএনপির গণসমাবেশ সামনে রেখে ঢাকার বাইরে থেকে কোনো ‘বহিরাগত’ যাতে আবাসিক হোটেল ও মেসগুলোয় উঠতে না পারে, সে জন্য তল্লাশি চালাবে পুলিশ। অকারণে ঢাকার বাইরের কোনো বাসিন্দাদের ঢাকায় অবস্থান করতেও দেবে না। ইতোমধ্যে আবাসিক হোটেলগুলোর সঙ্গে কথা বলেছে স্থানীয় থানা পুলিশ। একই সঙ্গে ঢাকার প্রবেশ পথগুলোতেও তল্লাশি চৌকি বসিয়ে লোক-সমাগম ঠেকানোর কৌশল নেবে পুলিশ।
বিএনপিকে ২৬ শর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে পুলিশ। তবে বিএনপি নয়া পল্টনে সমাবেশ করতে অনড়। এমন প্রেক্ষাপটে বহুমাত্রিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা সাজাচ্ছে পুলিশ। বিএনপি যাতে নয়া পল্টনে সমাবেশ করতে না পারে, সে জন্য অন্তত তিন দিনি আগেই ওই এলাকা পুলিশ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। আবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকেন্দ্রিক নিরাপত্তা পরিকল্পনাও সাজানো হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকে। সমাবেশ কেন্দ্র করে বঙ্গভবন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা জোরদারেও পুলিশ কাজ করছে। ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকেই এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
বিএনপির সূত্র জানিয়েছে, গত তিন দিনে রাজধানীতে বিপুলসংখ্যক বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে। এর মধ্যে কলাবাগান থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইয়াসিন, ধানমন্ডি থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক পলাশ, লালবাগ থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আফতাব ইয়াকিনকে ডিবি গ্রেপ্তার করেছে। ওয়ারী থানাধীন ৪১ নং ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য আমিনুল ইসলাম নয়ন, বংশাল থানা বিএনপি নেতা মো. নাদের ও কোতোয়ালি থানাধীন ৩২ নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা আলাউদ্দীন আলাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন, পশ্চিম মানিকদি ইউনিট বিএনপির সভাপতি ইব্রাহিম হক, ক্যান্টনমেন্ট থানা বিএনপি নেতা জুয়েল মাস্টার, আবদুল হান্নান, আহমেদ আলী, পল্লবী থানা বিএনপি নেতা শাকিল আল হাসান, ভাটারা থানা বিএনপি নেতা মেহেদী হাসান সোহেল, হাসান, শফিকুল ইসলাম, ফয়সাল, আলমাস, সোহেল, মোহাম্মদ জাকির ও কামাল গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়া দক্ষিণখান থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি শাহাবুদ্দিন সাগর, বিমানবন্দর থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি জুলহাস পারভেজ মোল্লা, কাফরুল থানা বিএনপি নেতা মো. হেলাল উদ্দিন গ্রেপ্তার হয়েছেন। ৯২ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওমর ফারুক, ২০ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল ভূঁইয়া ও ২১ নং ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক রইসুল ইসলাম রনককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।