১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপির মধ্যে কয়েকদিন ধরেই চলছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রশাসন বলছে- সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে- নয়াপল্টন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কেই তারা সমাবেশ করবে। দুই পক্ষের এমন অনড় অবস্থানে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ১০ ডিসেম্বর আসলে কী হতে যাচ্ছে? - এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এক ধরনের উৎকণ্ঠা আছে। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বা সাধারণ গণজমায়েতের জন্য একটি উন্মুক্ত স্থান বা ময়দানের প্রয়োজনীয়তা সামনে এসেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসও ময়দান থাকার পক্ষেই কথা বলে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঢাকায় একসময় রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ হতো ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে। আর ছোট ছোট বা তাৎক্ষণিক সমাবেশ হতো মুক্তাঙ্গনে। সেই পল্টন ময়দানে এখন ক্রীড়াঙ্গনের বিভিন্ন ভবন নির্মাণ করে দখল করা হয়েছে। আর মুক্তাঙ্গনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এসটিএস, পাবলিক টয়লেট ও গাড়ি রাখার জায়গা করা হয়েছে। ফলে জায়গা দুটিতে আর সমাবেশ করার অবস্থা নেই।
সমাবেত হতে পারে না নেতাকর্মীরা। তা হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ কোথায় হবে, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এক সময় মুক্তাঙ্গন, পল্টন ময়দান ব্যবহার করে রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন এমন দুজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সামরিক শাসকরা মানুষের একত্রিত হওয়াকে ভয় পেত। সেই ভয়ে অতীতের সামরিক ও স্বৈরশাসকরা বিভিন্ন সময় মানুষের একত্রিত হওয়ার স্থানগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগ একই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, খোলা জায়গা আরও বেশি থাকা দরকার, যাতে মানুষ জমায়েত হয়ে রাস্তায় নয়, ময়দানে ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন আমাদের সময়কে বলেন, যে কোনো দেশের জন্য পাবলিক স্কয়ার বা ময়দান থাকা উচিত। শুধু রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ নয়, যেখানে যে কোনো পাবলিক ডে-তে মানুষ মিলিত হতে পারে। জনগণ তাদের মতামত তুলে ধরতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সামরিক সরকারগুলো বিভিন্ন সময় ঢাকার খোলা জায়গা, মাঠ বা পার্কগুলো বন্ধ করে দেয়। জিয়া পল্টন ময়দান বন্ধ করে মুক্তাঙ্গন চালু করেন। সেটিও টিকে রইল না। মুক্তাঙ্গনে ৫০০ লোক নিয়ে সভা-সমাবেশ করা যেত। সেটি এখন আর নেই। ঐতিহাসিক পল্টন ময়দান জিয়া-এরশাদ দুজন মিলে ধ্বংস করেছেন। আসলে তারা কখনই চাইত না মানুষ একত্রিত হোক। বাকি ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, সেখানে গাছ লাগিয়ে ময়দানের ঐতিহ্য ধ্বংস করা হয়েছে। তিনি বলেন, ওসমানী উদ্যান আদর্শ জায়গা হতে পারত, সেখানেও গাছ লাগিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হলো। এখন তো আর কোথাও খোলা জায়গা রইল না। মানুষ তাদের মনের কথা বলবে কীভাবে? তাই বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ছে।’ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স আমাদের সময়কে বলেন, বিভিন্ন সময় সামরিক শাসক ও স্বৈরাচারী শাসকরা জনগণকে একত্রিত হতে দিতে চায়নি। যে কারণে পল্টন ময়দান, মুক্তাঙ্গনের মতো জায়গা বন্ধ করে দেয়। তারা মনে করে জনগণ একত্রিত হতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন করবে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি যখনই যে দল ক্ষমতায় ছিল- তারাও সামারিক শাসকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। তিনি বলেন, ‘বিশে^র সব দেশেই জনগণের সমবেত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট স্থান রয়েছে। আমরা মনে করি, মানুষের মতপ্রকাশের জন্য এসব জায়গা আরও বাড়ানো উচিত। যখনই সব জায়গা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন জনগণ মতপ্রকাশের জন্য বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। মানুষের ভোগান্তি হয়।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও নগরপরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান আমাদের সময়কে বলেন, যে কোনো আধুনিক রাষ্ট্রে স্কয়ার বা ময়দান থাকাটা আবাশ্যক। দেশে নতুন করে তো হয়নি, বরং যেগুলো ছিল- সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। ওসমানী উদ্যান, সোহরাওয়ার্র্দী উদ্যানও উন্নয়নের নামে উদ্যানের চরিত্র নষ্ট করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে যেখানে ২০ কোটি মানুষের বসবাস; সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে মতপ্রকাশের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, দেবে। তাই সংশোধন করে হলেও নতুন স্কয়ার বা ময়দান সৃষ্টি করতে হবে। অডিটরিয়ামে বসে মতপ্রকাশ হয় না।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ব্রিটিশ আমলে একটি নতুন সেনানিবাস গড়তে ঢাকার তখনকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস নবাবপুর ও ঠাঁটারীবাজার ছাড়িয়ে শহরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বেশকিছু অংশ সংস্কার করেন। সেখানে সিপাহিদের ছাউনি, অফিসারদের বাসস্থান ও প্যারেড গ্রাউন্ড করা হয়। এই এলাকাটিই বর্তমান পল্টন বা পুরানা পল্টন এলাকা। পল্টন ছিল ঢাকার বিলুপ্ত নদী পা-ুর তীরে অবস্থিত। মশা, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন উপদ্রব ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে সেনানিবাসটি পরিত্যক্ত হয়। ১৯৫৩ সালে সেনানিবাস লালবাগে স্থানান্তরের পর পল্টন এলাকাটির পরিচর্যার দায়িত্ব মিউনিসিপ্যাল কমিটির কাছে দেওয়া হয়। উনিশ শতকের শেষার্ধে পল্টনে মাঝেমধ্যে জনসভা হতে শুরু করে। পাকিস্তানপর্বে এই ময়দানই ছিল মুক্তিকামী বাঙালির আন্দোলন-সমাবেশের মূল কেন্দ্র। স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র ছিল পল্টন ময়দান। তবে জিয়াউর রহমানের সময়ে পল্টনে সভা-সমাবেশের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করায় সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়তে শুরু করে। নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় আবার প্রাণ ফিরে পায় পল্টন ময়দান। তবে এরশাদের পতনের পরের প্রায় দেড় যুগে এই ময়দান ধীরে ধীরে ঔজ্জ্বল্য হারাতে থাকে।
মোহাম্মদ হানিফ ঢাকার মেয়র থাকার সময়ে পল্টন ময়দানকে সিটি করপোরেশনের অধীনে নিয়ে সমাবেশের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের পর এ ময়দানের নিয়ন্ত্রণ পায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। বর্তমানে পল্টন ময়দানে ক্রীড়া পরিষদের বিভিন্ন ভবন নির্র্মাণ করে দখল করা হয়েছে।
বাংলাপিডিয়ার তথ্যানুসারে, ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন এবং ৭ মার্চ পর্যন্ত তাঁর সংগ্রামের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মুক্তাঙ্গন সম্পর্কে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তান আমলে প্রায় ৮৪ শতাংশ জমির ওপর মুক্তাঙ্গন পার্কটি গড়ে ওঠে। জিপিওর পশ্চিম কোলঘেঁষা পার্কটি ১৯৭৯ সাল থেকে রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের জন্য ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ১৯৯০ সালের পর থেকেই পার্কটি দখল শুরু হয়। রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়ীরা পার্কটির একাংশ দখল করে নেন। সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এক আদেশে মুক্তাঙ্গনে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এখনো তা বহাল আছে। বর্তমানে সেখানে গড়ে উঠেছে পাবলিক টয়লেট। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন মুক্তাঙ্গনের টয়লেট উদ্বোধন করেন। মুক্তাঙ্গনের আরেকাংশে ডিএসসিসির একটি ময়লা স্থানান্তর কেন্দ্র (এসটিএস) ও গাড়ি রাখার স্থায়ী জায়গা করে দখল করা হয়েছে।