সিলেটের বালাগঞ্জ বঙ্গবীর জেনারেল এমএজি ওসমানীর জন্মভূমি। বালাগঞ্জ মুক্ত দিবস আজ। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি, বঙ্গবীর জেনারেল এমএজি ওসমানীর পৈত্রিক ভূমি বৃহত্তর বালাগঞ্জ উপজেলা (বর্তমান ওসমানীনগর উপজেলাসহ) হানাদার মুক্ত হয়। 
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর সকাল ৬টার সময় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাতাছড়া থেকে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা বালাগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল কামালের নেতৃত্বে এ বাহিনীর অন্যান্য সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন মুছব্বির বেগ, শফিকুর রহমান, মনির উদ্দিন, ধীরেন্দ্র কুমার দে, নীহারেন্দু ধর, আব্দুল খালিক, জবেদ আলী, সিকন্দর আলী, আমান উদ্দিন, লাল মিয়া, মনির উদ্দিন আহমদ, মজির উদ্দিন আহমদ, মো. সমুজ আলী, আব্দুল বারী ও অন্যান্যরা। 
এদের মধ্যে ২৬ জন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পথে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলা সদর থেকে যান। বাকী ১৪ জনের দলটি ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর অধিনায়ক আজিজুল কামালসহ ফেঞ্চুগঞ্জ থানার মাইজগাঁও এলাকার আব্দুল গণি মাস্টার ও বদরুল হক নিলুর বাড়িতে ওঠেন। সেখান থেকে একই দিন রাত ১২টার সময় রওনা হয়ে রাত ২টার সময় ইলাশপুর রেল সেতুর নিকট অবস্থান গ্রহণ করেন। পরদিন ভোরে একদল পাক সেনা সিলেট থেকে ফেঞ্চুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি হয়। সেখানে প্রায় আধা ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানী সৈন্যরা শেষ পর্যন্ত ২টি এসকেএস রাইফেল ও বেশ কিছু গোলা বারুদ ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
এরপর মুক্তিযোদ্ধারা ইলাশপুর সেতু অতিক্রম করেন। এ সময় বড়লেখা থেকে ২৬ জনের দলটিও সেখানে এসে পৌঁছায়। এতে মনোবল আরো বেড়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা ইলাশপুর সেতুর অবস্থান থেকে ৬ ডিসেম্বর ভোর রাতে রওনা হয়ে সন্ধ্যা ৭টার সময় প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে বর্তমান বালাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাছে পৌঁছান। 
সেখানে থেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়। সংবাদ পাওয়া যায়, বালাগঞ্জ থানায় পাক বাহিনী নেই।
তবে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে একদল বাঙ্গালী পুলিশ রয়েছে। সেদিন রাজশাহীর বদিউজ্জামান, বিয়ানীবাজার নিবাসী ডা. জাকারিয়া ও কাজিপুর নিবাসী আব্দুছ সুলতান বার্তা বাহকের কাজ করেন। ইতোমধ্যে রাত নেমে আসে। রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা থানা ভবনে অবস্থানকারী পুলিশ বাহিনীকে ঘেরাও করে ফেলেন।
৭ ডিসেম্বর সকালে বার্তা বাহক দুই জনকে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট আত্মসমর্পণের নির্দেশ পাঠানো হয়। পুলিশ বাহিনী তখন দুই ঘণ্টা সময় প্রার্থনা করে। কিন্তু অধিনায়ক আজিজুল কামাল ঘোষণা করেন বড়জোড় ১০ মিনিট সময় দেওয়া যেতে পারে। অতঃপর সিদ্ধান্ত হয় পাক হানাদারের ওই দোসরা সকাল ৯টায় অস্ত্র সমর্পণ করবে। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক পুলিশ বাহিনী থানা ভবনের মালখানায় অস্ত্র জমা দেয় এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সকাল পৌনে ১০ টায় মুক্তি বাহিনীর অধিনায়কের নিকট চাবি হস্তান্তর করেন।
সেদিন আত্মসমর্পণের পর উপজেলা সদরস্থ সাব-রেজিস্ট্রারী অফিস প্রাঙ্গণে মুক্তিকামী অসংখ্য মানুষের ভিড় জমে। 
অধিনায়ক আজিজুল কামাল হাতে স্টেনগান উঁচিয়ে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা শান্ত থাকুন, এখন সব কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, বালাগঞ্জের পুলিশ বাহিনী এবং রাজাকাররা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আজ আমরা মুক্ত।’
ওইদিন সকাল ১০টার সময় থানার সম্মুখ প্রাঙ্গণে কুয়াশা ঘন সকালে মাঠের এক পার্শ্বে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সারিবদ্ধভাবে লাইন করে অবস্থান গ্রহণ করেন। সবার হাতে অস্ত্র। অধিনায়ক আজিজুল কামাল মুক্তিবাহিনীর ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে উপস্থিত জনতার সামনে পরিচয় করিয়ে দেন। এসময় উৎসুক জনতা বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের অভিবাদন জানান। আর মাঠে জড়ো হওয়া সবাই চূড়ান্ত বিজয়ী হয়ে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ছড়িয়ে পড়েন বালাগঞ্জের গ্রাম থেকে গ্রামে।
বালাগঞ্জ মুক্ত দিবস নিয়ে আলাপকালে বিজয়ী দলের অন্যতম সদস্য দেওয়ান বাজারের জামালপুরের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মজির উদ্দিন আহমদ ও উজিয়ালপুরের বাসিন্দা মো. সমুজ আলী বলেন, ‘একাত্তরের সেই দিনের কথা ভোলার নয়। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে আমরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। আমরা চাই, আমাদের এই মাতৃভূমি শান্তি, সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক।’