বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের মুহুর্মুহু রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড আর বিএনপি নেতা-কর্মীদের ইটপাটকেল নিক্ষেপে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় নয়াপল্টনসহ আশপাশ এলাকা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন সোয়াত পুলিশের সদস্যরা। এতে একজন নিহত ও পুলিশসহ শতাধিক আহত হয়েছেন। আহতের মধ্যে অন্তত ২৪ জনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যরা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের বেশির ভাগই বিএনপি কর্মী ও গুলিবিদ্ধ। এ ছাড়া সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত মকবুল হোসেনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল মর্গে রাখা হয়েছে। পরে পুলিশ বিএনপি কার্যালয়ের ভিতরে অভিযান চালিয়ে কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম-মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগরী উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, মহানগরী দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলসহ অবস্থানরত সব নেতা-কর্মী ও স্টাফ মিলিয়ে শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করে নিয়ে যায়। অভিযানের পর পুলিশের পক্ষে বিএনপি কার্যালয় থেকে বোমা উদ্ধারের দাবি করা হয়। এর আগে বিকাল ৩টার দিকে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে। এ সময় প্রথমে লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। নেতা-কর্মীরাও পাল্টা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশের অ্যাকশনে একপর্যায়ে নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।
সংঘর্ষ চলাকালে বিকাল ৪টার দিকে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলীয় কার্যালয়ের ভিতরে প্রবেশ করতে গেলে পুলিশ তাকে বাধা দেয়। পরে কার্যালয়ের সামনে ফুটপাতে অবস্থান নেন তিনি। এ সময় মির্জা ফখরুল অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাকে আমার কার্যালয়ে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ পুলিশ, বোমা ডিসপোজাল ইউনিটের লোকজন ঢুকছে, বের হচ্ছে। আমরা সন্দেহ করছি তারা ভিতরে বোমাজাতীয় কিছু রেখে এর দায় আমাদের ওপর চাপাবে।’
এদিকে নয়াপল্টনে এ সংঘর্ষের জন্য পুলিশ ও বিএনপি একে অন্যকে দায়ী করেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল জোনের উপকমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, ‘সমাবেশের স্থান নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন এ সংঘর্ষ শুরু হয়। পল্টনে বিএনপি নেতা-কর্মীরা ভিড় করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে পুরো রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা তাদের সরে যেতে বারবার অনুরোধ করি। কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনেননি। একপর্যায়ে তাদের সরিয়ে দিতে গেলে তারা পুলিশের ওপর হামলা করেন।’ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, ‘একটা ভয়াবহ, ভীতিকর ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা আশা করতে পারি না, একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের সামনে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। সরকার পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।’ ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ। সমাবেশের স্থান নিয়ে কয়েক দিন ধরেই উত্তেজনা চলছে। বিএনপি নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুমতি চাইলে পুলিশ তা নাকচ করে দেয়। পুলিশের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু বিএনপি সেখানে সমাবেশ করবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়। নয়াপল্টনের বিকল্প হিসেবে আরামবাগে অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়। এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছে বিএনপির প্রতিনিধি দল। গতকাল পুলিশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর কথা ছিল। কিন্ত এর আগেই বেধে যায় সংঘর্ষ। সমাবেশের স্থান নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, বিকল্প স্থান আরামবাগে অনুমতি না দিলে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই সমাবেশ করবে তারা। ঢাকা বিভাগের ১১টি সাংগঠনিক জেলার নেতা-কর্মীদের নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। হাইকমান্ডের নির্দেশ পেয়ে রাজধানীর আশপাশের নেতারা সেখানে জড়ো হতে থাকেন। কয়েক দিন ধরে ঢাকা মহানগরী বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে সরকারবিরোধী নানা স্লোগান দেন। অনেকে সেখানে রাতযাপনও করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অন্যান্য দিনের মতো গতকাল সকাল থেকেই নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতা-কর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। একপর্যায়ে তাদের ভিড় বেড়ে সড়কের এক পাশে গাড়ি চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় পুলিশ তাদের সড়ক ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু নেতা-কর্মীর ভিড় বেশি থাকায় সড়ক থেকে সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু পুলিশ তাদের সড়কে অবস্থান নিতে বাধা দেয়। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। মুহূর্তেই তা রূপ নেয় সংঘর্ষে। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ শটগানের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। জবাবে বিএনপি নেতা-কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এ সময় পল্টন থানার সামনে ও নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে পুলিশের বিশাল বহর নয়াপল্টনের কার্যালয় অভিমুখে মার্চ করে। রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করতে করতে তারা সামনে এগোতে থাকে। তাদের সঙ্গে যোগ দেন সোয়াত বাহিনীর সদস্যরাও। সঙ্গে ছিল রায়ট-কার, এপিজি, জলকামান। মুহুর্মুহু গুলি, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড ও পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দে আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পথচারীরা বিগি¦দিক ছুটতে থাকে। বিএনপি নেতা-কর্মীরা শুরুতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। কিন্তু পুলিশের সাঁড়াশি আক্রমণের সামনে তারা বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। কার্যালয়ের সামনে থেকে পিছু হটে। অনেকে কার্যালয়ের ভিতরে ও আশপাশের গলিতে অবস্থান নেয়। বিভিন্ন গলির ভিতর ঢুকেও গুলি চালায় পুলিশ। পুলিশ কেন্দ্রীয় কার্যালয় লক্ষ্য করে অসংখ্য টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এতে কার্যালয়ের ভিতরে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। পুলিশের গুলিতে আহত কয়েকজন কার্যালয়ের ভিতরে প্রবেশ করেন। পরে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হয়।
সন্ধ্যার দিকে নয়াপল্টনসহ আশপাশ এলাকা পুলিশ নিয়ন্ত্রণে নেয়। বিকালে কার্যালয়ের ভিতরে অভিযান চালায়। সেখানে থাকা নেতা-কর্মীদের বেধড়ক লাঠিচার্জ করা হয়। ভিতর থেকে আটক করা হয় অনেককে। তল্লাশির নামে কার্যালয়ের ভিতরে থাকা বিভিন্ন ফাইল তছনছ করা হয়। কার্যালয়ের ভিতর থেকে ১৪-১৫টি ককটেল উদ্ধার করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের।
এদিকে মির্জা ফখরুল যখন একা ফুটপাতে বসে পড়েন তখন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা তাঁর পাশে এসে অবস্থান নেন। যারাই মহাসচিবের পাশে আসেন তাদের প্রায় সবাইকে ছোঁ মেরে ধরে নিয়ে প্রিজন ভ্যানে তুলে নেয় পুলিশ। কয়েক দফায় নয়াপল্টনের সামনে থেকে অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়। সন্ধ্যার দিকে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের প্রচারের জন্য থাকা দুটি ট্রাকও নিয়ে যায় পুলিশ।
নিহত মকবুল হাসপাতালে, ভর্তি ২৪ জন : পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে সড়কে পড়ে ছিলেন মকবুল হোসেন। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান মোস্তাফিজ নামে এক পথচারী। তিনি জানান, সড়কে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে মকবুলকে তিনি হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত অবস্থায় আরও ২৪ জনকে ভর্তি করা হয়।
এদিকে ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জানান, পুরো পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পুলিশ অ্যাকশন মুডে। কতজন আহত হয়েছে বা গ্রেফতার হয়েছে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেননি। তবে উভয় পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন বলে জানান তিনি।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমরা নয়াপল্টন এলাকা থেকে ১৬০ বস্তা চাল উদ্ধার করেছি। পৌনে ২ লাখ বোতলজাত পানি উদ্ধার করেছি। এসব আনা হয়েছিল রান্নাবান্না করে খেয়েদেয়ে অবস্থান নেওয়ার জন্য। সমাবেশের তিন দিন আগে থেকেই নয়াপল্টনের সামনে অবস্থান নিয়েছিল তারা।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ৩ শতাধিক নেতা-কর্মীকে আটক করেছি। কারও বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, কারও বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট রয়েছে। এগুলো খতিয়ে দেখে পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের অনেক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিএনপি কার্যালয় থেকে ককটেল ছোড়ার কারণে আমাদের পুলিশ সদস্যরা আহত হয়েছেন। ১৫টি ককটেল নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে।’
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আজ বিকাল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করবে বিএনপি। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এতে বক্তব্য দেবেন।
ভারপ্রাপ্ত দফতর সম্পাদক প্রিন্স : বিএনপির দফতর সম্পাদক রুহুল কবির রিজভীকে আটকের পরিপ্রেক্ষিতে ভারপ্রাপ্ত দফতর সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ ইমরান সালেহ প্রিন্সকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।