রাজনীতির বাজারে নতুন পার্টির ধুম!

চিররঞ্জন সরকার
  ০৬ মে ২০২৫, ২০:২৫


এ বছর আলুর বাম্পার ফল হয়েছে। মাঠভরা আলু আর ‘ঠেলাভরা’ দাম দেখে দেশের মানুষ দিশেহারা। কিন্তু এর চেয়েও বিস্ময়কর ও বর্ণাঢ্য বাম্পার ফলন দেখা যাচ্ছে রাজনীতির খেতখামারে— নতুন রাজনৈতিক দলের বৃষ্টির মতো সৃষ্টি! ২০২৪ সালের ৫ অগাস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর হঠাৎ যেন রাজনীতিতে এক অদ্ভুত ‘ফুল ফোটানো বসন্ত’ নেমে এসেছে— এটা কোনো আদর্শিক নয়, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের জাগরণ!
দল, আরো দল, আরো নতুন দল। রাত ২টায় হঠাৎ ঘুম ভেঙে কেউ যদি ভাবে, ‘আরে! আমি এখনো দল গঠন করিনি?’— সকালে উঠে সঙ্গে সঙ্গে ফেইসবুক লাইভ দিয়ে নতুন পার্টির উদ্বোধন করে ফেলতে পারেন! পোস্টার, স্লোগান, হ্যাশট্যাগ সব একবেলাতেই তৈরি করা সম্ভব।
শান্তি-স্বস্তি-নিরাপত্তা থাক বা না থাক, দেশের রাজনৈতিক আকাশে এখন দল-নামক ফুলের মৌসুমি ঝলকানি। বসন্তকালে যেমন গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়, তেমনি আমাদের দেশেও উঁকি দিচ্ছে একেকটা রাজনৈতিক চারা। দেশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এটা আর কোনো স্বাভাবিক রাষ্ট্র নয়, একটা বিশাল ‘পলিটিক্যাল নার্সারি’। আর যারা এসব দল গড়ে তুলছে, তারা যেন জাত মালির নতুন প্রজাতি— কেউ ছাত্রনেতা, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ হুট করেই ‘সুশীল’ হয়ে উঠেছেন, সবাই যেন হাতের মুঠোয় একটা করে দল নিয়ে নেমে পড়েছেন ‘উন্নয়ন ও ন্যায়বিচারের বাজারে’।
বর্তমানে গণতন্ত্র এমন এক ‘স্মার্ট’ ফরম্যাটে পৌঁছেছে, যেখানে যার মোবাইলে ২০০০ টাকার মতো বিকাশ ব্যালান্স, সে-ই এখন আত্মবিশ্বাস নিয়ে দল খুলে ফেলে। উদ্দেশ্য পরে আসুক, দলটা আগে থাক। কেউ যদি বলে, ‘আপনার রাজনীতিতে আসার কারণ কী?’—উত্তর আসে, ‘ভাই, দল তো খুলছি, এখন একটা উদ্দেশ্য দাঁড় করাচ্ছি... টাইম লাগবে একটু।’
গড় হিসেবে প্রতিমাসে জন্ম নিচ্ছে তিনটি করে রাজনৈতিক দল। যেন ‘পলিটিক্যাল ফার্টিলিটি রেট’ এখন জাতিসংঘের হিসাবেও রেকর্ডযোগ্য হতে পারে! আগে মানুষ সন্তান নিত ভবিষ্যতের জন্য, এখন কেউ কেউ নেয় দল— দল মানে স্বপ্ন, সম্ভাবনা, ফান্ড, লাইভ শো আর আমন্ত্রণপত্র!
‘একটি দল, একটি স্বপ্ন, একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট’— এই নতুন স্লোগানেই জমে উঠেছে রাজনীতির হাট। কেউ ভাবছে না এসব দল আদৌ টিকে থাকবে কিনা। সবার লক্ষ্য আপাতত একটি ইউটিউব চ্যানেল, একটা লোগো, আর অন্তত দুটো প্রেস ব্রিফিং।
রাজনীতির এই ঋতুতে কেউ পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, কেউ নিজ দলের সদস্যই সামলাতে পারছে না— তবে নতুন দল গড়ার উৎসাহে কারও ঘাটতি নেই! সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে যদি কারও মাথায় হঠাৎ দল গড়ার ভাব আসে, দুপুরের মধ্যেই তিনি ফেইসবুক লাইভে গিয়ে বলে দেন, “আজ আমরা ইতিহাস গড়লাম— নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘জন-প্রেরণা মুক্তি আন্দোলন’ (জেপিএমএ) ঘোষণা করছি।”
এই সময়ে জন্ম নেওয়া সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক দলের নাম জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)— যাদের নেতৃত্বে রয়েছেন গত বছর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তুখোড় ছাত্রনেতারা। তাদের একজনের সফেদ পাঞ্জাবি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দামি ও সফেদ পাঞ্জাবি তিনি পরতে পারবেন না এমনটা যারা বলছেন, তারা কিন্তু কাজটা ঠিক করছেন না। তবে ওই সফেদ পাঞ্জাবিওয়ালার শত শত গাড়ি নিয়ে শক্তি প্রদর্শনের ঘটনাটা ভুলবার নয়।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে এনসিপির আরেক নেতার বক্তব্য রাখাটা ব্যাপক ক্ষুব্ধ করেছে বহু মানুষকে। তার এমন বক্তব্য রাখা নিশ্চয়ই কাউকে কাউকে খুশিও করছে। তবে দল হিসেবে এনসিপি নিজেদের যে মধ্যপন্থা অনুসারী বলে পরিচিত করাতেЍ
* চায়, তা প্রশ্নবিদ্ধ করছে এই রকম নেতার ভূমিকা।
অনেকের কাছে এনসিপি মানে নতুন নতুন চমক। তারা সরকারে থেকেও নেই, আবার না থেকেও আছে! কখনও জুলাই ঘোষণাপত্রের জন্য আল্টিমেটাম দেওয়া, কখনও দুর্নীতির অভিযোগে দলের নেতাকে বিদায় করা, কখনও নিজেরা নিজেরা ফেইসবুকে ঝগড়া করার মধ্য বেশ আলোচনায় আছেন।
আরও যে সব নতুন পার্টি এসেছে, তাদের নতুন নতুন নাম শুনে সাধারণ মানুষ বেশ দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছে। ‘বাংলাদেশ আ-আম জনতার পার্টি’— নামটা শুনলেই কেউ ভেবে বসতে পারেন, এটা বুঝি রাজশাহীর কোনো আমচাষি সমিতি। আবার কেউ ‘বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি’ শুনে ভাবতে পারেন, এরা হয়ত রাতে চোর-ডাকাত তাড়াতে ‘জাগো বাহে’ কবিতা চালান।
দলগঠন ও দলের নামকরণের এ তেলেভাজা যুগে কেউ ভাবছেন না, আদর্শটা কী, লক্ষ্যটা কী, জনগণের জীবনে কী প্রভাব ফেলবেন তারা! বরং যার যার ‘নেমিং সেন্স’ যত ভালো, তার দল তত আলোচনায়। যেন এটা রাজনীতি নয়, নতুন আইসক্রিমের ফ্লেভার লঞ্চের প্রতিযোগিতা!
রাজনীতির এই বসন্তে সবচেয়ে ব্যস্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে প্যাড ছাপার প্রেস আর ভিজিটিং কার্ড প্রিন্টার। কেউ বলছেন, ‘ভাই, আমাদের দলের ফন্টটা একটু মোটা কইরা দেন— দর্শনে দৃঢ়তা বোঝাবে।’ আরেক নেতা বলেন, ‘আমাদের লোগোটা একটু বৃত্তাকারে দেন, যেন ঐক্যের প্রতীক হয়!’ অথচ দলের মধ্যে ঐক্য নেই, কেবল ডিজাইনে ঐক্যের ছাপ।
আবার দেখুন, এখন বেশ কিছু দল গঠন করা হচ্ছে ওয়েস্টিন, ইন্টারকন্টিনেন্টাল, র‌্যাডিসন, মুভেনপিক— এমন হোটেলে। আগে যেখানে গরিব মানুষ মিটিং করত টং দোকানে, সেখানে এখন ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা হয় কাচের গ্লাসে রঙিন জুস নিয়ে। কেউ কেউ বলেন, ‘আমরা গণমানুষের কথা বলতে এসেছি’— আর বলেন ট্যাপাসের বুফে লাইনে দাঁড়িয়ে। ইনসাফ মানেই এখন একটি ইভেন্ট, একটি শোডাউন, একটি রিল!g‡
39এভাবে চলতে থাকলে সামনে হয়তো এমন দলও গড়ে উঠবে, যাদের উদ্দেশ্য হবে ‘বিচারহীনতার বিরুদ্ধে ফটোসেশন’ বা ‘গণতন্ত্র রক্ষায় কন্টেন্ট ক্রিয়েশন!’
দল এখন গণমাধ্যমে প্রবেশের টিকিট, সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিতি পাওয়ার মাধ্যম, আর অদূর ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার শিফটের সার্টিফিকেট। নেতা হবার আগে ফেইসবুকে ‘পাবলিক ফিগার’ প্রোফাইল খোলা হয়, এরপর আসে ওয়েবসাইট, তারপর একটি কালারফুল মোবাইল অ্যাপ— যেখানে দলের মেনিফেস্টো, স্লোগান, এবং ‘নেতার লাইভ লোকেশন’ দেখা যাবে।
একটা সময় ছিল, রাজনীতি ছিল আত্মত্যাগ, আদর্শ এবং সংগ্রামের নাম। এখন রাজনীতি অনেকটা কনটেন্ট ক্রিয়েটরের লাইভ স্ট্রিমের মতো— যেখানে লাইক কম পড়লেই মন খারাপ, কমেন্ট বেশি হলে দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আর শেয়ার কম হলে ‘আন্দোলন স্থগিত’ ঘোষণা করা হয়।
এই রকম এক নতুন দলের কর্মী প্রশ্ন করে বসল, ‘ভাই, আমাদের মূল আদর্শ কী?’ নেতা চিন্তিত মুখে বললেন, ‘আদর্শ… মানে… ওটা আমরা চূড়ান্ত করছি, ফোকাস এখন লোগো ডিজাইনে।’
আবার এক বিদেশি কূটনীতিক এক বাংলাদেশি রাজনীতিককে জিজ্ঞেস করেন— ‘আপনাদের দেশে এত নতুন দল হয়, তাতে কি গণতন্ত্র মজবুত হয়?’ বাংলাদেশি নেতা বললেন, ‘দল যত বেশি, মিটিং তত বেশি। মিটিং যত বেশি, পুলিশি নিরাপত্তা তত বেশি। পুলিশ যত ব্যস্ত, দুর্নীতি তত নিশ্চিন্ত!’
তবে এক আঁতেলের মতে, নতুন নতুন দল মানেই দেশে শান্তি। ধরা যাক, নতুন ৪০টা দল বলল, দেশে নির্বাচন দরকার নাই। বিপরীতে ৪টা বলল, দরকার আছে। এর গণতান্ত্রিক ফল কী? গণতন্ত্র বলে সংখ্যাগরিষ্ঠতাই সিদ্ধান্তের মাপকাঠি। কাজেই নো নির্বাচন। নো ঝামেলা। বিদেশিরাও একমত হবেন। ৪০-৪ ভোটে নির্বাচন পরাস্ত হয়েছে। তখন আমরা ‘যেমন আছি তেমন রব।’ কেবল দেশে কালবোশেখী নয়, বইবে কেবল শান্তি, সংস্কার আর উন্নয়নের সুবাতাস!
এই হলো আমাদের গণতন্ত্রের করুণ অথচ রঙিন বাস্তবতা। এখানে এখন নতুন দল মানেই পরিচয়, পরিচয় মানেই সংযোগ, সংযোগ মানেই সম্ভাবনা। জনগণের চাওয়া, সমস্যার সমাধান, বা ভবিষ্যতের চিন্তা— সবই পরের বিষয়। আগে ফেইসবুক পেইজ চালু হোক, ব্যানার উঠুক, ফটোসেশন হোক— তারপর দেখা যাবে ‘দেশ কোথায় যাচ্ছে।’
রাজনীতি যেন আর জনগণের দাবি-দাওয়ার বস্তুনিষ্ঠ চর্চা নয়, বাণিজ্যিক ফ্যান্টাসির একেকটা পর্ব! আমরা যদি নাটকের খারাপ অভিনয়ে সমালোচনা করি, তাহলে রাজনীতির চোরা নাটকে চুপ থাকা কেন? না করলে, আমরা সত্যিই হয়ে যাব এক অদ্ভুত ‘দর্শক জাতি’— যাদের চোখ বড়, কিন্তু স্মৃতি ছোট।
ইতি, ‘গণতন্ত্রের নতুনতম সিজন দেখে হা করে তাকিয়ে থাকা’ এক দর্শক।

bdnews24.com