বাংলা নববর্ষ ১৪৩২

নব আঙ্গিকে প্রত্যাশার প্রতিচ্ছবি

মো. বায়েজিদ সরোয়ার
ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০২

আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হলো নতুন বাংলা বর্ষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ। ১৪৩২ বঙ্গাব্দের এই প্রথম দিন সবাইকে নতুন বছরের সালাম ও শুভেচ্ছা। নতুন বছরটি সবার আনন্দে ও শান্তিতে ভরে উঠুক। নতুন বছর মানেই নতুন প্রত্যাশা। উদ্যম আর সাহস নিয়ে আবার পথচলা শুরু।
পহেলা বৈশাখ আমাদের সব সঙ্কীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবনব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মনের ভেতরের সব ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে নতুন উদ্যমে বাঁচার অনুপ্রেরণা জোগায়। আমরা যে বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ ও সংস্কৃতি নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়।
অন্যদিকে পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের বাঙালির একটি সর্বজনীন লোক-উৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় বাংলা নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুল-ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্্যাপিত হয় নববর্ষ।
আজ পহেলা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মাতবে সারাদেশ। ভোরের প্রথম আলো রাঙিয়ে দেবে নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাকে। রাজধানী এবং দেশজুড়ে থাকবে বর্ষবরণের নানা আয়োজন।
‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩২’ জাঁকজমকপূর্ণভাবে ও নতুন আঙ্গিকে উদ্্যাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বেশকিছু নতুন ধরনের উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। দিনটি সরকারি ছুটির দিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। ছায়ানট ভোরে রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। সুরের ধারার বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হবে ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবরে।
এ ছাড়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন যথাযোগ্য মর্যাদায় বাংলা নববর্ষ উদ্্যাপন করবে। বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে।
এক সময় নববর্ষ পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির, কারণ কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভর। পরে কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে (১৫৫৬) বাংলা সন গণনার শুরু হয়। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সন।
রাজধানীতে পহেলা বৈশাখের উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিল্পী ও শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে আয়োজিত এই শোভাযাত্রা পুরো উৎসবকেই বর্ণাঢ্য করে তোলে। বাংলা নববর্ষের এবারের শোভাযাত্রায় বাঙালি ছাড়াও ২৭টি জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ থাকবে বলে জানিয়েছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি বলেছেন, ‘সরকারের গৃহীত সব ব্যবস্থার মূলে আছে কালচারাল হিলিং এবং কালচারাল ইনক্লুসিভনেস।’
শোভাযাত্রায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন (বাম্বা) যুক্ত হচ্ছে। প্রায় ২০০ গিটারবাদকসহ শোভাযাত্রায় অংশ নেবে বাম্বা। ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মানুষের প্রতি সংহতি জানিয়ে তারা- ‘ফ্রম দ্য রিভার টু সি, প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি’ গানটি গাইবে। উল্লেখ্য, গত ১২ এপ্রিল থেকে পুরনো বছরকে বিদায় জানাতে এবং নতুন বছরকে বরণ করে নিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী নানা নামে উৎসব উদ্্যাপন করছেন।
গত ১৪৩১ সাল (২০২৪) ছিল স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির বছর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। ‘৫ আগস্ট ২০২৪ তথা ৩৬ জুলাই’, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব এক বিজয় অর্জন হয়েছে। পতন হয়েছে ফ্যাসিবাদী শাসনের। এই গণ-অভ্যুত্থানকে অনেকে ‘জুলাই বিপ্লব’, ‘বর্ষা বিপ্লব’ বা ‘শ্রাবণ বিদ্রোহ’ বলেও অভিহিত করেছেন।
এবারের নতুন বছর বাংলাদেশের মানুষের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ছাত্র-জনতার স্বপ্নের ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর কথা এখন বহুল আলোচিত। এই নতুন বাংলাদেশ হবেÑ উদার, সুশাসিত, বৈষম্যহীন, শোষণহীন, গণতান্ত্রিক, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক। এখানে ফ্যাসিবাদ, স্বৈরাচার, দুর্নীতি ও উগ্রপন্থার স্থান থাকবে না। রক্তাক্ত একটি অধ্যায় পেরিয়ে ক্রমেই শান্ত হয়ে আসছে বাংলাদেশ। তবে দেশে এখনও স্থবিরতা কাটেনি। দেশ এখনও সংকটমুক্ত হয়নি। এখনও জানা-অজানা কিছু অশুভ শক্তি ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তাই সরকার ও সংগ্রামী ছাত্র-জনতাকে রাষ্ট্র পরিচালনা ও সংস্কারে বেশ সাবধানী ও কুশলী হতে হবে। এক ধরনের অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। ৮ আগস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরও দেশে-বিদেশে সরকারবিরোধী অপতৎপরতা, ষড়যন্ত্র এখনও থামেনি। সরকার ও জনগণকে এ বিষয়ে এ বছর খুবই সতর্ক থাকতে হবে।
শুধু অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ নয়, ১৪৩২ সালের বড় চ্যালেঞ্জ আসতে পারে বাইরে থেকে। গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে ভারতের মিডিয়া ও রাজনীতিবিদদের একাংশ থেকে বাংলাদেশবিরোধী কার্যক্রম চলছে। অন্ততপক্ষে এক ধরনের ‘ইনফরমেশন ওয়ার’ চলছে। পার্বত্য চট্রগ্রামের পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা হতে পারে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিষয়ে মহাসতর্ক থাকতে হবে।
এদিকে দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে আরাকান আর্মি রাখাইনের প্রায় ৯০% অঞ্চল দখল করেছে। বলতে গেলে বাংলাদেশের এক নতুন প্রতিবেশী তৈরি হয়েছে। সেখানে এখন জটিল পরিস্থিতি। এই অঞ্চল থেকে নতুন ধরনের বিপদ আসতে পারে। এ বিষয়ে আমাদের করণীয় নতুনভাবে ভাবতে হবে। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কিছু সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই ডেটারেন্স অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্তকরণের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।
বর্তমানে একটি উদ্বেগজনক বিষয় হলো, জুলাই বিপ্লবের অংশীজনদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভাজন। বিপ্লবের অন্যতম শক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনীকেও একটি শক্তি বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। গত ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে (কনফারেন্স হলে) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। জাতীয় ঐক্যের এই ডাক ছিল ১৪৩১ সালের আরেক মহৎ অর্জন। বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে হবে।
এখন ঐক্যের সময়। বিভাজন, বিদ্বেষ নয়, আমাদের অনুপ্রাণিত করুক ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও কল্যাণকামিতা। ১৪৩২ সাল আমাদের জীবনে প্রার্থিত সুন্দর দিনগুলো বয়ে আনুক। সব প্রতিকূলতা, চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে, বাধা পেরিয়ে নতুন এই বছরে এগিয়ে যাক আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রাণের বাংলাদেশ। সবাইকে বাংলা নববর্ষের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।

মো. বায়েজিদ সরোয়ার : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক ও বিশ্লেষক