ইউনূসের ‘পদত্যাগ’ ভাবনা : যেভাবে সংকট কাটতে পারে

সাইমুম পারভেজ
  ২৪ মে ২০২৫, ১১:৪২

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হতাশা প্রকাশ ও পদত্যাগ করার ভাবনা প্রসঙ্গে নানা আলোচনার জন্ম হয়েছে। বাড়ছে গুজব, অনিশ্চয়তা ও প্রশাসনিক স্থবিরতা, যা সংকট হয়ে উঠতে পারে।
গত ৫ আগস্ট কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন ও গণবিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনার পলায়নের পরে শাসনক্ষমতায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর ঐকমত্যের ভিত্তিতেই অধ্যাপক ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের যে জনভিত্তি ও বৈধতা, তা তৈরি হয়েছে গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতার সমর্থনের কারণেই।
বাংলাদেশে জনসমর্থন ও সাংগঠনিক কাঠামোর বিস্তার ও কার্যকারিতার দিক থেকে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল এখন বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় এবং পরেও এই সরকারের প্রতি সরাসরি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন এবং এ সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না বলে পরিষ্কার করেছেন।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও সমর্থন পেয়ে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নাগরিক সমাজের মধ্যেও গণ-অভ্যুত্থানে গঠিত এই সরকারের পক্ষে ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও আশা। কিন্তু কোন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিএনপি, নাগরিক সমাজের সঙ্গে এই সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের দূরত্ব তৈরি হলো, তা বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।
বিএনপি প্রথম থেকেই খুব জরুরি সংস্কারে ঐকমত্য তৈরি করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বারবার আহ্বান করেছে। গত আট মাসে এই প্রথম মেয়র ইশরাকের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত করতে সরকারের গড়িমসি ও ছাত্রদল নেতা সৌম্য হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে রাজপথে অবস্থান নিল বিএনপি। এখন পর্যন্ত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার দাবিতে রাজপথে বড় ধরনের আন্দোলন করেনি বিএনপি।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে একটি অংশ এত দিন বিএনপির সাংঘর্ষিক অবস্থান না নেওয়ার সিদ্ধান্তকে ‘দুর্বলতা’ হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের মনে রাখা উচিত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র বিএনপিরই দেশব্যপী আন্দোলন করার সাংগঠনিক শক্তি রয়েছে। এমনকি রাজধানী ঢাকাতেও বিএনপির জনসমর্থনের যে ভিত্তি ও রাজপথে সাংগঠনিক শক্তির যে সামর্থ্য, তাকে খাটো করে দেখা ভুল হবে।
সরকারের ভেতরে থাকা একটি ছোট চক্র, কিছু ‘জনতুষ্টিবাদী’ ইউটিউবার ও মব উসকে দেওয়া কয়েকজন ব্যক্তি ছাড়া এই সরকারের জনভিত্তি ও শক্তির উৎস যে মূলত রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের কাছ থেকেই আসে, তা সবার কাছেই পরিষ্কার।
প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, নাগরিক সমাজ ও অতিসম্প্রতি সেনাপ্রধানের বক্তব্যে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার বিষয়টি জোরালোভাবে উঠে এসেছে। অর্থাৎ যে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও সামরিক সমর্থনে এই সরকার গঠিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে ডিসেম্বরে বা খুব শিগগিরই নির্বাচন অনুষ্ঠান করার বিষয়ে একটি ঐকমত্য আমরা লক্ষ করছি।
এর বাইরে জামায়াতের নেতাদের বক্তৃতায়ও বিভিন্ন সময় ডিসেম্বরে না হোক, আগামী বছরের প্রথম দুই-এক মাসের মধ্যে নির্বাচন করার কথা উঠে এসেছে। অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগ বিষয়ে আলোচনা ওঠার পর এনসিপির দু-একজন জ্যেষ্ঠ নেতাও নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে তাঁদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় অধ্যাপক ইউনূসকে ক্ষমতায় রেখেই যত তাড়াতাড়ি, সম্ভব হলে ডিসেম্বর বা তার আগেই একটি জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা উচিত।
কোনো দেশে সামরিক বাহিনী জনসাধারণের ভোটে একটি নির্বাচিত সরকার গঠনের দিকে জোর দিচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে বড় অংশগুলোও তা–ই চাচ্ছে, কিন্তু একটি বেসামরিক সরকার তা নিয়ে গড়িমসি করছে, এটি একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ হয়ে থাকবে।

জুলাই হত্যাকাণ্ডের মূল কুশীলবরা পালিয়ে গেলেন, হত্যাকাণ্ডের বিচারে স্থবিরতা তৈরি হলো, ঢালাও হত্যা মামলা দেওয়া হলো এবং অপ্রয়োজনীয় ও কম গুরুত্বপূর্ণ গ্রেপ্তার করে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের গুরুত্বকে খাটো করা হলো।‘মবতন্ত্র’ তৈরি করে দেশে অরাজকতা তৈরি করা হলো, বেশ কিছু মাজারে হামলা হলো, রাস্তাঘাটে নারীদের হেনস্তা করা হলো। গণ-অভ্যুত্থানের শিক্ষার্থী নেতা ও উপদেষ্টা পরিষদে থাকা শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও সবার মুখে মুখে।


অধ্যাপক ইউনূসের মনে রাখা উচিত, যাঁরা তাঁর পক্ষে ‘পাঁচ বছরের জন্য চাই’ প্রচারণা চালিয়েছেন, তাঁরাই এই পরিস্থিতি তৈরির জন্য দায়ী। অধ্যাপক ইউনূসের মাহাত্ম্য ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করে নয়; বরং স্বল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচিত সরকারের কাছে সফলভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমেই প্রকাশ পেত।
বাংলাদেশের ইতিহাসে যেসব তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন করেছে, তারাই ইতিহাসে প্রশংসনীয় হয়ে রয়েছে। যাঁরা অনির্বাচিত সরকারকে দীর্ঘায়িত করতে চেষ্টা করেছেন, তাঁরা রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনেও শ্রদ্ধার জায়গা হারিয়েছেন।
আমরা আশা করেছিলাম, গণ-অভ্যুত্থানের কারণে অভূতপূর্বভাবে গঠিত এই সরকার জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঠিক ও সুষ্ঠু বিচার শুরু করবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো চিহ্নিত করে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করে সংস্কারের পরিকল্পনা দেবে এবং একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে যেন নির্বাচিত সরকার ঐকমত্যের ভিত্তিতে নেওয়া সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে।
এর বিপরীতে আমরা খেয়াল করলাম, জুলাই হত্যাকাণ্ডের মূল কুশীলবরা পালিয়ে গেলেন, হত্যাকাণ্ডের বিচারে স্থবিরতা তৈরি হলো, ঢালাও হত্যা মামলা দেওয়া হলো এবং অপ্রয়োজনীয় ও কম গুরুত্বপূর্ণ গ্রেপ্তার করে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের গুরুত্বকে খাটো করা হলো।‘মবতন্ত্র’ তৈরি করে দেশে অরাজকতা তৈরি করা হলো, বেশ কিছু মাজারে হামলা হলো, রাস্তাঘাটে নারীদের হেনস্তা করা হলো। গণ-অভ্যুত্থানের শিক্ষার্থী নেতা ও উপদেষ্টা পরিষদে থাকা শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও সবার মুখে মুখে।
অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অংশ রাজনৈতিক দলগুলোকে আমলে কম নিয়ে, নিজেরাই দেশের মূল সংস্কার করে ফেলবে এবং একলাফে রাষ্ট্রের কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসার ‘ইউটোপিয়ান’ ধারণায় বুঁদ হল। অপ্রয়োজনীয়ভাবে মানবিক করিডর দেওয়া, বন্দরের কাজে বিদেশি কোম্পানিকে নিয়ে আসা ইত্যাদি ‘গ্র্যান্ড স্কিম’–এর প্রতি আগ্রহ দেখা গেল।
সবচেয়ে বড় ভুলটি হচ্ছে, এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও সামরিক বাহিনী, যাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই সরকার গঠিত, তাদের সঙ্গে আলোচনার কোনো প্রয়োজন মনে করেনি অন্তর্বর্তী সরকার। বরং একজন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হলো, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। কারণ, বরাবরই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুটি প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টার আওতাধীনই থাকে।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বিতর্কিত অবস্থান ও রাজনৈতিক, সামরিক শক্তির সঙ্গে আলোচনা না করার কারণে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার দায়ভার ইউনূস সরকারের ওপরেই বর্তায়। তাই রাষ্ট্রীয় কাজে অসহযোগিতার অভিযোগ না তুলে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত, কীভাবে তার জনভিত্তির উৎসগুলোর মতামতকে আমলে নিতে হয়, তা শেখা।
কোনো যদি-কিন্তু ছাড়া ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি নির্দিষ্ট তারিখ অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা করতে হবে। শিক্ষার্থী নেতৃত্বের উচিত মাটিতে নেমে আসা এবং বাস্তবতার সঙ্গে বোঝাপড়া করা। সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণ যাকে ভোট দেবে, সেই রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করবে। ‘বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যাবে, তাই সেটি যেকোনোভাবে বন্ধ করতে হবে’ এটি কোনো যৌক্তিক চিন্তা নয়। বরং জামায়াত ও এনসিপির উচিত জনগণের কাছে যাওয়া এবং যতটা সম্ভব বেশি আসন পেয়ে বিএনপিকে মোকাবিলা করা।
কোনো আইন ও সংবিধানের মারপ্যাঁচের মাধ্যমে বিএনপিকে ঠেকানোর চেষ্টা কারও জন্যই ভালো ফল বয়ে আনবে না। ছাত্র নেতৃত্বের উচিত ‘ইউটিউবার’ বা ‘মবসৃষ্টিকারীদের’ সঙ্গে নয়, বরং বিএনপির সঙ্গে একটি রাজনৈতিক মিত্রতায় যাওয়া। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সেটিই এখন কাঙ্ক্ষিত ও এনসিপির রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য সেটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হবে।
 লেখক: বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিশেষ সহকারী
সূত্র: প্রথম আলো