কথিত আছে দু’জন ব্রিটিশ এক হলে নাকি আবহাওয়া নিয়ে আলাপ শুরু করেন। দু’জন ফরাসি এক হলে শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। দুজন আমেরিকান এক হলে মশগুল হয়ে পড়েন শেয়ার মার্কেট নিয়ে। আর দু’জন বাঙালি এক হলে নির্ঘাত রাজনীতি নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দেন। গণতান্ত্রিক দেশ অথচ গণতন্ত্রের কোন চর্চা নেই, যতটা না রাজনীতি নিয়ে চর্চা হয় এখানে। পল্টন ময়দানের কথা এ প্রজন্মের কেউ শুনেছে কিনা সন্দেহ আছে , তবে যে কোনো ময়দান থেকে চায়ের দোকান পর্যন্ত, রাষ্ট্র প্রধান ও তার আশীর্বাদপুষ্ট দল থেকে সকল রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী থেকে সকল কর্মজীবী মানুষ এমনকি দিনমজুর, রিকশা বা ভ্যানচালক পর্যন্ত এদেশে সবাই রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত।
মুরুব্বিরা বলেন - "আমাদের দেশের রাজনীতি এখন নীতিহীনতার বেড়াজালে আবদ্ধ, অর্থাৎ রাজনীতির মধ্যে 'পলিটিক্স' ঢুকে গেছে।" আমাদের জাতীয় ঐক্যের পথে মূল বাঁধা হলো রাজনীতি। বিগত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বড় অভ্যুত্থানের পরও ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালত সর্বত্র এখন বিভক্তি। আর এ বিভক্তির প্রধান কারণ হলো রাজনীতি। যে কোন জাতীয় ইস্যুতে আমাদের নেতা-নেত্রীরা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবেন কি, নিজেরাই বরং মারাত্মকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। অথচ এ বিভক্তি কোন নীতির জন্য নয়, আদর্শের জন্যও নয়, কেবলই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অথবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। যারা রাজনীতিমু্ক্ত পরিচয়ে নিরপেক্ষতার কথা বলে এখন দেশ চালাচ্ছেন, তাদের কর্মকাণ্ডকেও অনেকে এখন গভীর রাজনৈতিক নীলনকশা হিসেবে দেখছেন!
আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন যেন একটি রঙ্গমঞ্চ, আর রাজনীতিবিদগণ এবং সেইসাথে দলকানা সুশীলগণ যেন একেকজন তুখোড় ভাঁড়। এদেশের রাজনীতির রং-তামাশা আর ভাঁড়ামি দেখলে স্বয়ং গোপালভাঁড়ও যদি এযুগে জন্মগ্রহণ করতেন, তবে নির্ঘাত লজ্জায় মুখ লুকাতেন। দেশের তথাকথিত সচেতন সিনিয়র সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী কিংবা হালের ইউটিউবারগণ ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধার লোভে যেভাবে ক্ষমতাসীনদের পদলেহন করে কথা বলেন মিডিয়ার সামনে, তাতে তারা লজ্জা না পেলেও লজ্জা পাই আমরা হতাশ আমজনতা। আমাদের রাজনৈতিক ভাঁড়ামি আর ভণ্ডামির কিছু নমুনার দিকে এবার কিছুটা দৃষ্টি দেওয়া যাক।
আমাদের রাজনীতিবিদগণ কথায় কথায় বুকের রক্ত রাজপথে ঢেলে দিতে চায়, কিন্তু ‘খোঁজ-দ্য সার্চ’ করলে দেখা যাবে, অনেক রাজনীতিবিদই জীবনে এক ফোঁটা রক্তও ব্লাডব্যাংকে দান করেন নাই। ব্লাডব্যাংকে অবশ্য দূষিত রক্ত নেয়া হয় না। 'রাজনীতিবিদদের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র’। তবে ওটা কোন ফুল! ধুতরা ফুল, ডুমুরের ফুল, না ফুলকপির ফুল? তা এখনো কেউ জানাতে পারেনি। এরা নির্বাচনের আগে ভিখারির মতো জনগণের কাছে ভোট ভিক্ষা করেন। কিন্তু ভিক্ষা পেয়ে ক্ষমতায় গিয়ে মনিবের মতো আচরণ শুরু করেন।
ক্ষমতায় যাওয়ার আগে এরা জনগণকে স্বপ্ন দেখান, ক্ষমতায় গিয়ে সে স্বপ্ন নষ্ট করেন। অতঃপর নিজের চৌদ্দগুষ্টির স্বপ্ন পূরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
রাজনীতিতে নীতি কোথায়! 'দূরে....বহুদূরে...।' তাইতো রাজনীতিতে এত দুর্নীতি। আর তাইতো দেশ সারা বিশ্বের মধ্যে দুর্নীতির র্যাংকিং এ বরাবর শীর্ষ অবস্থানের দিকেই থাকে। আগের বছরগুলো থেকে এক, দুই, তিন ধাপ নিচে নামলেই তারা খুশিতে ডুগডুগি বাজান। রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি আর আষাঢ়ের গল্পের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, জনগণ দুটোই মুগ্ধ হয়ে শোনে, আবার খুব সহজে তা ভুলেও যায়।
রাজনীতিবিদগণ হলেন দেশের সবচেয়ে সুবিধাবাদী শ্রেণি। এরা বলতে গেলে কোন কাজই করেন না, (পারলে সকল কাজে বাগড়া দেন) অথচ সব কাজের ফল ভোগ করেন। এরা হলেন ব্যাঙের মতো। ব্যাঙকে যেমন একপাল্লায় মাপা যায় না, দুএকটা লাভ দিয়ে এদিক-সেদিক সটকে পড়বেই। আমাদের রাজনীতিবিদরাও একই প্ল্যাটফর্মে বেশিদিন অবস্থান করেন না, একসময় ডিগবাজি মারবেনই। ইতিহাসতো তাই বলে! তারা তখনই সত্য কথা বলেন, যখন একে অন্যকে চোর আর দুর্নীতিবাজ বলে গালিগালাজ করেন।
রাজনীতি হলো ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ'র মতো। এদেশে সরকারি দল বা সরকারের মদদ নিয়ে রাজনীতি করলে আর কিছুই করা লাগেনা, টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, ক্ষমতা-সব হাতের মুঠোয় চলে আসে। রাজনীতি অতি লাভজনক এক পেশা। তাই সব পেশার লোক এখন রাজনীতিতে ঢুকছে। এ যেন এক মধুর হাঁড়ি, তাই মৌমাছি আর পিঁপড়ার সারির মতো সবাই রাজনীতিতে এসে ভিড় করছেন। বিশেষ করে এ সময়টায় কেউ এই সরকারের ছাতার নিচে, আবার দূরদর্শীরা আগামী নির্বাচনে বিজয় সুনিশ্চিত ভেবে সেই দলের অনুরাগী হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত করার চেষ্টা করছেন। যাদের কাছ থেকে জীবনেও যে রাজনৈতিক দল সম্পর্কে একটি ভালো কথা কখনো শোনা যায়নি, পরিস্থিতি বুঝে ভোল পাল্টিয়ে তাদের অনেকের মুখেই প্রতিনিয়ত নানারকম স্তুতির ফেনা তুলতে দেখা যাচ্ছে!
রাজনীতিবিদ আর ছারপোকার মধ্যে দারুণ মিল, উভয়েই জনগণের রক্ত চুষে মোটাতাজা হয়। তবে ছারপোকা রক্ত চুষে লুকিয়ে থাকে, কিন্তু রাজনীতিবিদদের অপকর্ম অনেকটাই প্রকাশ্য।
রাজনীতিবিদগণ এবং সন্ত্রাসীদের সঙ্গে জেলখানার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। কিন্তু সন্ত্রাসীরা জেলে গেলে কুখ্যাত হয়, আর রাজনীতিবিদরা হন বিখ্যাত।
রাজনীতিবিদরা যা বলেন তা করেন না, যা করেন তা বলেন না। এদের স্মৃতিশক্তিও কাউয়ার মতো ক্ষণস্থায়ী, এরা সকালে যা কিছু বলেন, বিকালে তা ভুলে যান।
রাজনীতি এবং ব্যবসা দুটোই এখন অতীব লাভজনক । তাই সকল রাজনীতিবিদ এখন ব্যবসায়ী, তবে সব ব্যবসায়ীই রাজনীতিবিদ নন।
রাজনীতিবিদগণ ক্ষমতায় থাকলে বিরোধীদলের হাত থেকে ‘জনগণের জানমাল’ রক্ষার জন্য অতিমাত্রায় তৎপর হোন, আর ক্ষমতায় না থাকলে নিজেরাই জনগণের জানমাল ধ্বংস করেন। আমাদের রাজনীতিবিদগণ দেশের সব সমস্যা দূর করার জন্য প্রাণপাত করেন, কিন্তু তারা জানেন না যে তারাই দেশের মূল সমস্যা। তারা যত কর্ম-অপকর্ম করে থাকেন, সবই জনগণের দোহাই দিয়ে করে থাকেন। তাইতো বাস্তবে ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে তাদের ভাষ্যমতে দুই দলের সাথেই যেহেতু সব জনগণ, সে হিসাবে তো জনসংখ্যা ৩৪ কোটি হওয়ার কথা!
সরকারে থাকলে এরা কথায় কথায় অবরোধ, বিক্ষোভ ইত্যাদির বিরুদ্ধে ফতোয়া দেন, আর বিরোধীদলে থাকলে ‘এর সবই গণতান্ত্রিক অধিকার’ বলে ব্যাপক গলাবাজি করে থাকেন। ‘মেরেছো কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দিবো না!’ হাঁ, আমাদের রাজনীতিবিদদের আমরা খুব ভালোবাসি। ভালোবেসে বারবার প্রতারিত হই, তারপরও ভালোবাসি। জানি না আমাদের এ অন্ধ ভালোবাসার শেষ কোথায়!
পূনশ্চঃ তারপরও আমাদের দেশে এখনো অনেক সৎ, নীতিবান, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ রয়েছেন। সব দলের মধ্যেই তাদের বিচরণ রয়েছে। কিন্তু সন্ত্রাস, কালোটাকা, আর পেশীশক্তির দাপটের কাছে তারা অসহায়। তাদের কণ্ঠ যেন আজ স্তব্ধ, বিবেক যেন ঘুমন্ত, সাহস যেন লুপ্ত। এখন সময় এসেছে তাদের জেগে ওঠার, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তোলার। এসব সৎ, দেশপ্রমিক নেতারা জেগে উঠলেই রাজনীতি থেকে দূর হবে অনাচার, দূর হবে জঞ্জাল। কিন্তু তেমনটা হতে হলেতো সাধারণ জনগণের সমর্থন খুব দরকার। কিন্তু সেই মুক্তিযুদ্ধ চেতনাসম্পন্ন মানুষ কই - যারা একসময় জোরালো কণ্ঠে গাইতো সেই প্রিয় গানটি - 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি..!' চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলন আমাদের জীবনে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হলেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সাথে তার তুলনা যারা করে, তারা কখনোই বাংলাদেশ নামক ভূ-খণ্ডের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয় বলে আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি।
লেখক: সমাজ বিশ্লেষক ও গবেষক।