
হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে ইসলাম ধর্মের শেষ নবী হিসেবে ভবিষ্যদ্বাণী করে বহিরা নামে একজন খ্রিষ্টান পাদ্রী ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়েছেন। তিনি প্রচলিত অর্থের কোনো জ্যোতিষী ছিলেন না বরং খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল শাস্ত্রের একজন পণ্ডিত ছিলেন। বাইবেল ও খ্রিষ্টানশাস্ত্র অধ্যয়নের মাধ্যমে তিনি যে জ্ঞান অর্জন করেন তা প্রজ্ঞায় পরিণত হয়েছিল বলেই তার পক্ষে একজন বালককে দেখে তার ভবিষ্যৎ গতিপথ বলে দেওয়া সম্ভব হয়। শুধু বহিরা নয়, আরও প্রজ্ঞাবান মানুষ ওই সময়ে বাস করতেন। তারাও হজরত মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে নানা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসির আদ দামেশকী তার লেখা আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে সেই বিষয়ে বর্ণনা করেছেন। ইবন কাসির তার উপর্যুক্ত গ্রন্থে ইমাম আবু নুয়ামের দালায়িলুন নবুওয়াত গ্রন্থের উদ্ধৃতিতে ইবন আব্বাস (রা.) বর্ণিত হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর দাদা আবদুল মুত্তালিবের জীবনের একটি ঘটনা তুলে ধরেন। ওই ঘটনার বিবরণে জানা যায় যে, আবদুল মুত্তালিব এক শীতের সফরে ইয়ামেন যান। তার ওই সফরে তিনি একজন ইহুদি পণ্ডিতের সঙ্গে দেখা করেন। ওই ইহুদি পণ্ডিত আবদুল মুত্তালিবের অনুমতি পেয়ে গভীর মনোযোগে তার নাকের দুটি ছিদ্র পরীক্ষা করেন। পরীক্ষার সময়ে ইহুদি পণ্ডিতের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি আনন্দচিত্তে বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ‘তোমার এক হাতে রয়েছে রাজত্ব অন্য হাতে নবুয়াত।’
আবদুল মুত্তালিব নিজে নবুয়াত ও রাজত্ব লাভ না করলেও তার উত্তরসূরি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) নবুয়াত পেয়েছিলেন। মদিনায় উম্মাভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠা করার গৌরব অর্জন করেছিলেন। নানা ঐতিহাসিক বিবরণে ইসলামের ইতিহাসে অমন বহু ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। দেখা যায় যে পণ্ডিতরা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ছক বলে দিচ্ছেন। ওই বলে দেওয়া প্রচলিত অর্থের গণকদের মতো হাতের রেখা পরীক্ষা করার ফল নয় রবং জ্ঞান অর্জনের ফলে তাদের মধ্যে যে প্রজ্ঞার সমাহার হয়েছিল তারই ফলে সমসাময়িক সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও পঠন-পাঠনের মাধ্যমে তাদের পক্ষে অমন রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হয়।
ভয় সংক্রমক। একবার ভয় জেগে বসলে সহজে বাঘ-হরিণ একঘাটে জল খায়। ভয়কে জয় করা সহজ নয়। মহারাজা লক্ষণ সেন ও তার সেনাবাহিনী ভয়কে জয় করতে পারেননি বলেই একজন আঞ্চলিক সেনানায়কের কাছে তার রাজ্য তিনি হারিয়েছিলেন।
বাংলার ইতিহাসে যুগ পরিবর্তনকারী সমরনায়ক বখতিয়ার খলজির সময়ও অমন ঘটনা মহারাজা লক্ষণ সেনের দরবারের ইতিহাস থেকে জানা যায়। তবকাত নাসিরি গ্রন্থের বিবরণে মিনহাজ দাবি করেন, লক্ষণ সেন যখন রাজা হন তখন তিনি মাতৃগর্ভে ছিলেন। তার পিতা বল্লাল সেনের মৃত্যুর খবর শুনে সেনদের রাজমুকুট লক্ষণ সেনের মায়ের পেটে বেঁধে দেওয়া হয়। রাজ্যের সভাসদ আমর্ত্যরা কোমর বেঁধে সদল বলে তার মায়ের সম্মুখে উপস্থিত হন। ওই উপস্থিতির মাধ্যমে তারা মাতৃগর্ভে থাকা রাজা লক্ষণ সেনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
মহারাজা লক্ষণ সেনের জন্মক্ষণে রাজদরবারের পণ্ডিতদের সমবেত করা হয়। এর মধ্যে যাদের দৈবজ্ঞান ছিল এমন পণ্ডিত ও ব্রাহ্মণরা ছিলেন। তারা কোষ্ঠি নির্ধারণ ও জন্মক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলেন যে এখন থেকে দুই ঘণ্টা পরে জন্মগ্রহণ করলে এই শিশুর ভাগ্যে দুর্ভাগ্য লেখা আছে। তারপক্ষে সিংহাসনে আরোহণ করা সম্ভব হবে না। কিন্তু যদি চার ঘণ্টা পরে জন্মগ্রহণ করে তবে শিশুটি খুব ভাগ্যবান হবে। তার রাজত্বকাল ৮০ বছর স্থায়ী হবে। রাজমাতা পণ্ডিতদের ওই ভবিষ্যদ্বাণী শুনে তার দুই পা উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখার আদেশ করেন। চার ঘণ্টা পরেই লক্ষণ সেন জন্মগ্রহণ করেন। বিনিময়ে তিনি মাতৃহারা হন। তার জন্মের ক্ষণে তার মা মারা যান।
পণ্ডিতদের ওই ভবিষ্যদ্বাণী মতে, লক্ষণ সেন ৮০ বছর রাজত্ব করেছেন ইতিহাসে অমন কোনো সাক্ষ্য নেই। কিন্তু তার রাজত্বকাল দীর্ঘ হয়েছিল। পণ্ডিতরা আশি সংখ্যাটি ৮০ বছর বুঝাতে নয় বরং রূপক অর্থে দীর্ঘরাজত্ব বোঝাতে ব্যবহার করেছিলেন। দেশ ও সন্তান ভক্ত রাজমাতার মতো ভবিষ্যৎদ্বক্তা পণ্ডিতদের সব যুগে প্রয়োজন রয়েছে। মায়ের জীবন উৎসর্গ ও পণ্ডিতদের প্রজ্ঞায় টিকে যায় রাজা ও রাজত্ব তার বহু প্রমাণ ইতিহাসে আছে। কিন্তু সবসময় পণ্ডিতরা রাজা ও তার রাজ্যকে রক্ষা করতে কাজ করেন বিষয়টি সত্য নয়। তারা রাজার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাও করেন ইতিহাসে এমন বহু প্রমাণ আছে। লক্ষণ সেনের শাসনকালের শেষ সময়ের ঘটনাও তার বড় প্রমাণ।
বখতিয়ার খলজির নদিয়ায় সামরিক অভিযানের খবর আগেই লক্ষণ সেন পণ্ডিতদের মাধ্যমে জানতেন। তবকাত নাসিরি গ্রন্থে মিনহাজ দাবি করেছেন যে, বখতিয়ার খলজির সামরিক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে মহারাজা লক্ষণ সেনের দরবারে পণ্ডিতরা সমবেত হন। ওই দলে দৈবজ্ঞানী ভবিষ্যৎদ্বক্তা পণ্ডিত, ব্রাহ্মণ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা ছিলেন। তারা মহারাজা লক্ষণ সেনকে বলেন, আমাদের ব্রাহ্মণদের প্রাচীনকালে রচিত শাস্ত্রগ্রন্থে লেখা আছে যে এই রাজ্য তুর্কিদের অধিকারে যাবে। এখন এই রাজ্য তুর্কি অধিকারের সময় এসেছে। পণ্ডিত ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিদের ওই কথা শুনে মহারাজা লক্ষণ সেন তাদের প্রশ্ন করেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের রাজ্য অধিকার করবেন তার সম্পর্কে কোনো বর্ণনা কি ওইসব গ্রন্থে আছে?’ জবাবে পণ্ডিতরা বলেন, ‘হ্যাঁ, মহারাজা! তার সম্পর্কে বর্ণনা শাস্ত্রগ্রন্থে আছে।’ প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থে লেখা আছে, ‘তিনি যখন দুই পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে সোজা হয়ে দুই হাত প্রসারিত করবেন তখন দুটি হাত এমনভাবে জানু স্পর্শ করবে যে আঙুলগুলো জানুসন্ধি অতিক্রম করে যাবে।’ মহারাজা লক্ষণ সেন গোয়েন্দাদের নিয়োগ করে জানতে পারেন যে বখতিয়ার খলজির দৈহিক বিবরণের সঙ্গে ওই শাস্ত্রগ্রন্থের বিবরণের মিল আছে।
কোনো শাস্ত্রগ্রন্থে উপর্যুক্ত কথা লেখা ছিল তা জানা যায় না। কিন্তু পণ্ডিত ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা স্পষ্টত শাস্ত্রগ্রন্থের দোহাই দিয়ে মহারাজা লক্ষণ সেন ও তার সামরিক বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের আগেই পরাজয়ের ভয় ঢুকিয়ে দেন। ওই ভয় এতটা প্রভাব রেখেছিল যে, মাত্র ১৭-১৮ জন সহচর নিয়ে লক্ষণ সেন নদিয়া নগরে প্রবেশ করলে তার অবয়ব দেখে সবাই আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে যান। কোনো প্রতিরোধের চেষ্টা কেউ করেননি। কিন্তু প্রতিরোধের চেষ্টা করলে পরাক্রমশালী ও যুদ্ধে অজেয় লক্ষণ সেনের রাজ্য অধিকার করা বখতিয়ার খলজির পক্ষে সহজ হতো না।
ভয় সংক্রমক। একবার ভয় জেগে বসলে সহজে বাঘ-হরিণ একঘাটে জল খায়। ভয়কে জয় করা সহজ নয়। মহারাজা লক্ষণ সেন ও তার সেনাবাহিনী ভয়কে জয় করতে পারেননি বলেই একজন আঞ্চলিক সেনানায়কের কাছে তার রাজ্য তিনি হারিয়েছিলেন।
সামরিক কৌশল ও রণনীতির অংশ হিসেবে শাস্ত্রগ্রন্থের দোহাই দিয়ে বখতিয়ার খলজির গুপ্তচররা লক্ষণ সেন ও তার সেনাবাহিনীর মনে ওই ভয় ঢুকিয়ে দিতে সফল হন। ভবিষ্যদ্বাণী ও ভয়ের রণনীতির মাধ্যমে বখতিয়ার খলজি একে একে লক্ষণ সেনের কাছে থেকে অধিকার করেন- নদিয়া নগর, সকনত ও বঙ্গ রাজ্যের ভূমি এবং লখনৌতি নগর ও তার পার্শ্ববর্তী জমিন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
salah.sakender@outlook.com
সূত্র: জাগো নিউজ