আমরা শুধু আর্টল্যাবের প্ল্যাটফর্ম দিয়েছি : রাজিব রাসেল

ডেস্ক রিপোর্ট
  ১৮ জুন ২০২৫, ১৪:৫৭

আমাদের অনেক ভালো মিউজিশিয়ান আছেন, ভালো শিল্পী আছেন। আর্টল্যাবের প্ল্যাটফর্মকে এই শিল্পীরাই প্রাণ দিয়েছেন। অনেক শিল্পী, যারা গান ভালোবাসেন এবং ভিন্ন আঙ্গিকে ভালো গান উপস্থাপন করতে চান-আমরা তাদেরকে সেই সুযোগ দিয়ে রুচি এবং পরিবেশনায় ভিন্নতা আনার চেষ্টা করেছি মাত্র। আর এভাবেই আর্টল্যাব গড়ে উঠেছে। আর্টল‍্যাবের কার্যক্রম সম্পর্কে কথাগুলো জানিয়েছেন রাজিব রাসেল। গত ১২ জুন প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আয়োজিত সাপ্তাহিক 'টক অফ দ‍্য উইক'-অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তিনি। পর্বটির উপস্থাপনায় ছিলেন সোহানা নাজনীন। পরিচালনায় এইচ বি রিতা।
রাজিব রাসেল একজন সুরকার, গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী যিনি পূর্ব ও পশ্চিম, দুই ধারার সংগীত দ্বারা প্রভাবিত। যদিও তাঁর সংগীতযাত্রা শুরু হয়েছিল একজন পারকাশনিস্ট হিসেবে, তবে তাঁর প্রধান মনোযোগ ছিল কী-বোর্ড বাজানোয়।১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে তিনি একজন স্বশিক্ষিত সংগীতশিল্পী হিসেবে সংগীতচর্চা শুরু করেন। বাংলাদেশের ও ভারতের বিভিন্ন প্রখ্যাত তারকা শিল্পীদের সঙ্গেও তিনি পারফর্ম করেছেন।এছাড়াও, তিনি বিভিন্ন লাইভ শো-তে সফলভাবে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন। রাজিব সংগীত ভিডিও প্রযোজনা ও পরিচালনাতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত।
শুরুতেই সোহানা নাজনীন জানতে চান, কীভাবে শুরু হয়েছিল সংগীতের পথচলা? পার্কাশনিস্ট থেকে কী-বোর্ড, তারপর কণ্ঠশিল্পী—এই যাত্রাটা কেমন ছিল?
রাজিব রাসেল বলেন, শুরু করার সেরকম নির্দিষ্ট কোন দিন-ক্ষণ নেই। গানের প্রতি সবসময়ই ভালোবাসা ছিল। আমাদের বাড়িতে গানের পরিবেশ ছিল, মা গান করতেন, বাবা গিটার বাজাতেন। পরিবারে শর্ত ছিল, শখের বসে যাইই করি না কেন পড়াশোনাটা যেন ঠিক রাখি। নব্বই দশকে ব্যান্ড মিউজিকের একটা জোয়ার আসে, আমরা তখন স্কুলে পড়ি। আমাদের অনেক বন্ধুরাই ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতো। ওদেরকে দেখেই আগ্রহ জন্মায়। প্রথমে আমি ড্রাম বাজানো দিয়ে শুরু করি, শেখার চেষ্টা এখনো চলছে। গান গাওয়ার ইচ্ছা থেকেই পরে গিটার বেছে নেই। আমেরিকার আসার পর থেকে আমি কিবোর্ড বাজানো শুরু করি। আমার ছোট ছেলে স্কুলে ভায়োলিন শিখছে। আমার স্ত্রী গান শুনতে ভালোবাসেন, আমাকে গান গাইবার জন্যে যথেষ্ট সাপোর্ট দেন। পারিবারিক প্যাশন ছাড়াও আমার নিজের একটা প্রোফেশন আছে। প্রফেশনের বাইরে পুরোটা সময়েই আমি মিউজিকের পিছনে ব্যায় করি। নিজের গানের জন্য না, বরং ভালো শিল্পীর গান প্রমোট করাই আমার উদ্দেশ্য।  
পূর্ব ও পশ্চিমের সংগীতধারার সংমিশ্রণে কোন শিল্পী বা ঘরানা তাকে বেশি প্রভাবিত করে-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত থেকে অনেক দুরে ছিলাম, আমাদের শুরুটা হয়েছিল ব্যান্ড সঙ্গীত দিয়ে। আমেরিকা আসার পর অনেক শিল্পীর সাথে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়। তখন বুঝেছিলাম আমাদের জানার অনেক কমতি আছে। ওয়েস্টার্ন এবং ইস্টার্ন মিউজিক নিয়ে একসাথে ফিউশন করার ভাবনা তখন থেকেই। ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গীতের সাথে ওয়েস্টার্ন বাদ্যযন্ত্রের মিশ্রণের এই ধারা অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে হয়ে আসছে। আমরাও আমাদের মতো চেষ্টা করে "আর্টল্যাবে'র মতো প্ল্যাটফর্ম শুরু করি। শ্রদ্ধেয় লাকি ভাই অসুস্থতার সময়ে উনার চিকিৎসার জন্যে একটা ফান্ড রেইজার প্রোগ্রাম করি। নিউজার্সির অনেক শিল্পীই এগিয়ে আসেন আমাদের সাথে। পরবর্তীতে দেখালাম 'আর্টল্যাব' গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। আমরা তখন ভিন্ন আঙ্গিকে ফোক গানগুলো ওয়েস্টার্ন মিউজিক দিকে করার কথা ভাবি।
রাজিব রাসেল দেশ–বিদেশের নানা গুণী শিল্পীর সঙ্গে কাজ করে সেই অভিজ্ঞতা থেকেই গড়ে তুলেছেন নিজের ব্যান্ড 'S&R and Friends'। নামের মতোই এখানে বন্ধুত্ব, সহযোগিতা আর সৃষ্টিশীলতার মিলন ঘটেছে। এই ব্যান্ড তৈরির পেছনের ভাবনা, সদস্য নির্বাচন, এবং ব্যান্ডের সংগীতধারার দর্শন সম্পর্কে তিনি বলেন, এই নামটা আমার ব্যান্ডমেট শোভনের দেয়া। আমাদের দুজনের নামের আদ্যক্ষর থেকেই এই নামকরন হয়েছে। ব্যাক্তিগতভাবে শোভন আমার শক্তির জায়গা। শোভন বাংলাদেশের বিখ্যাত একজন গিটারিস্ট, ভোকালিস্ট এবং ভালো  মিউজিশিয়ান। দুজনেই বিশ্বাস করি যে মিউজিকের মতোই বন্ধুত্বের কোন শেষ সীমানা নেই। এপার বাংলা-ওপার বাংলার শিল্পী এবং মিউজিশিয়ানদের নিয়ে একসাথে কাজ করার সুবাদে মিউজিকের সাথে জড়িত সবাই আমাদের বন্ধু। ফ্রেন্ডস নামটা সেখান থেকেই আসা। বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান সব দেশেরই প্রেজেন্টেশন আছে আমাদের ব্যান্ডে। আমরা রিপিটেটিভ মিউজিক থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। কদিন পর আমাদের একটা প্রোগ্রাম হতে যাচ্ছে যেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে ভালো শিল্পীরা আসবেন, কোলকাতা থেকে বিখ্যাত মিউজিশিয়ান আসবেন। বাপ্পা মজুমদার, তনিমা হাদি, চন্দন ভাই, ইন্ডিয়ান সাইড থেকে রূপঙ্কর, শুভমিতা, লোপা, অন্তরা এদের সবার সাথে কাজ করে অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেগুলো আমার কাছে অর্জন মনে হয়। কবিতা কৃষ্ণমূর্তির সাথে গান করার সময় এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে। এছাড়াও আমাদের সাথে 'আর্টল্যাব' এ যারা গান করেন তাদের অনেকেই শান্তি নিকেতন এবং কোলকাতার ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে গান শিখে এসেছেন।
রাজিব রাসেল ও তার সহকর্মী বন্ধুদের প্রচেষ্টায়  'আর্টল‍্যাব' প্ল‍্যাটফর্মটির কার্যক্রমে রয়েছে ভিন্নতা। বিভিন্ন সমাজসেবামূলক উদ্যোগ, ফান্ড রেইজিং, বিভিন্ন শিল্পীদের প্রতিভা খুঁজে বের করা এবং নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 'আর্টল‍্যাব' এর মূল উদ্দেশ‍্য ও কার্যক্রম সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে চান এইচ বি রিতা।
রাজিব জানান, আর্টল্যাব-এ গানের ক্রিয়েটিভিটি ছাড়াও অনেকগুলো এভিনিউ আছে। প্যান্ডামিকের বিষণ্ণ সময়ে আর্টল্যাবের একটা গ্রুপ পুরো উত্তর আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা শিল্পীদের নিয়ে একটা ফিচার করি। গান ছাড়াও আড্ডা হত, কিছু সেলিব্রিটি শিল্পীদেরও যোগ করলাম আমরা। বাংলাদেশ থেকেও অনেক শিল্পী জড়িত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট যখন বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলতে যায় তখন আমরা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে একটা গান তৈরি করি। টিভি চ্যানেলের অনুরোধে বৈশাখী গানও করেছিলাম। পরবর্তীতে আমরা বাংলাদেশের বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য গান করে ফান্ড রেইজ করেছি।
নিউইয়র্ক শহরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আয়োজনে শিল্পীদের একই গানের পুনরাবৃত্তি সম্পর্কে জানতে চান এইচ বি রিতা। রাজিব রাসেন বলেন, অনেক শিল্পীই হয়তোবা শর্টকাট নিতে চায়। জনপ্রিয় গানকে ব্যবহার করে তাড়াতাড়ি মানুষের মনের মধ্যে একটা ইমপ্যাক্ট ফেলতে চায়। আমি মনে করি, আমরা যদি গান পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন গান না নিয়ে আসি তাহলে শ্রোতাদের মধ্যে পরিবর্তন আসবে কিভাবে? এটা আমাদেরকেই করতে হবে। কিছু পুরানো গান জনপ্রিয় থাকবেই, উৎসবকে ঘিরে কিছু গান থাকবে। বাংলা গানের ভান্ডার অনেক বড়, অন্য গানকেও সামনে নিয়ে আসতে হবে।
সব ধরনের মিউজিক‍্যাল ইনস্ট্রুমেন্টে পারদর্শী হলেও রাজিব রাসেলের বাঁশি'র সাথে কোন সখ‍্য নেই। তার মতে, বাঁশি বাজানোটা যেমন কঠিন তেমনি এর সেন্সটাও ভিন্ন।  
সংগীত প্রযোজনা ও পারফরম্যান্সের মধ্যে কোনটা তাকে বেশি টানে-সোহানা নাজনীনের এই প্রশ্নের উত্তরে রাজিব বলেন, লাইভ পারফরম্যান্সের চাইতে অন্য কিছুতে বেশি আনন্দ পাবার কিছু নেই। লাইভে অডিয়েন্সের সামনে পারফর্ম করে গান গাওয়া বাদেও ইন্সট্রুমেন্ট বাজাই। দর্শকদের সাথে সরাসরি সংযোগ করার মাধ্যমেই আনন্দ লাভ হয় বেশি।স্টুডিওতে কোন গানের প্রোডাকশন হলেও সেটা আনন্দের হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের প্রখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, "প্রোগ্রাম নিয়ে স্মরণীয় মুহূর্তের চাইতে কঠিন মুহূর্তই বেশি। প্রতিটা প্রোগ্রামের চার পাঁচ মাস আগে থেকে সব শিল্পিদের সহযোগিতায় কাজ শুরু করি। উত্তর আমেরিকায় সবাইকে একসাথে করাটা একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। সবার জীবিকা, পেশা, সময় এবং দূরত্বকে জয় করেই একটা অনুষ্ঠান প্রাণ পায়। আমদের মতো ক্ষুদ্র মানুষের জন্যে এটা একটা মহাযজ্ঞ হয়ে যায়। অনুষ্ঠানের সময় কেমন আবহাওয়া থাকবে, ভালো সাঊন্ড হবে কিনা এটা নিয়েও শঙ্কা থাকে। একটা প্রোগ্রামে ৩৫টার মতো গান তৈরি করতে হয়, বেশির ভাগই ফিউশন টাইপ। আমাদের প্রোগ্রাম এখন দর্শক শ্রোতাদের মনে আগ্রহের সৃষ্টি করেছে, তারা এখন অপেক্ষায় থাকে আমাদের থেকে ভালো কিছু গান শোনার। আমাদের ভালো কিছু উপস্থাপিকা আছেন, তাদের প্রত্যেকের কন্ট্রিবিউশন আছে।"
ভবিষ‍্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে রাজীব রাসেল বলেন, সামনে ইন্সট্রুমেন্টাল ফিউশন এবং ক্ল্যাসিক্যাল ফিউশন নিয়ে কাজ করার প্ল্যান আছে।
 দর্শকদের প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও জুম সিস্টেমের কারণে এই গুণী শিল্পীর কণ্ঠে গান শোনা হয়নি। কিন্তু রাজিব রাসেলের কণ্ঠে তাঁর সংগীত জীবনের কিছু গল্প শুনেছেন দর্শক। সুর, শব্দ আর সৃষ্টির এই যাত্রা শুধুই তাঁর একার নয়, এটি জড়িয়ে আছে শিল্প, অনুভব আর সময়ের সঙ্গে। সংগীত শুধু কণ্ঠে নয়, আত্মায়ও বেজে ওঠে। রাজীব রাসেল সেই আত্মার সংগীতের একজন নিরব কারিগর। এভাবেই সেদিনের অনুষ্ঠানটি শেষ হয়। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার "টক অফ দ্য উইক" অনুষ্ঠানটি প্রতি বৃহস্পতিবার নিউইয়র্ক সময় রাত নয়টায়, ফেসবুক লাইভে সম্প্রচারিত হয়ে থাকে।