আমি আর ‘আরিফ আর হোসাইন’ আলাপ করতাম, কীভাবে সরকারকে হটানো যায়

বিনোদন ডেস্ক
  ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১:৫৬

সদ্য অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন চলচ্চিত্রকার মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। বিনোদন অঙ্গনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত এই নির্মাতা দায়িত্ব পেয়েছেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। শপথ নেওয়ার পরই তার পুরোনো কিছু ফেসবুক পোস্ট সামনে টেনে এনেছেন নেটিজেনদের অনেকে। সেসব তুলে ধরে ফারুকীকে আওয়ামী লীগ সরকারের ‘দোসর’ তকমা দেওয়া হচ্ছে। এতে ভীষণ মর্মাহত এই নির্মাতা সম্প্রতি লিখেছেন, আমি আর ‘আরিফ আর হোসাইন’ সেই ২০১২ সালে আলাপ করতাম, কীভাবে এই সরকারকে হটানো যায়।

আজ মঙ্গলবার রাতে সে প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ফারুকী। সেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন তিনি। তার দাবি, ২০১২ সাল থেকেই এই সরকারের পতন চেয়েছেন তিনি।
ওই পোস্টে ফারুকী লিখেছেন, ‘মাত্র দুই দিন হলো কাজ করছি। এর মধ্যে আমার ধারণা, আমার মন্ত্রণালয়ে সহকর্মীদের মাঝে এই ধারণা দিতে পেরেছি যে আমরা কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটাতে চাই। যেটা স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদে আমাদের সংস্কৃতি কর্মীদের কাজে আসবে। যাই হোক, যদিও আমি কোনও পদ চাই নাই, তবুও দায়িত্বটা নেয়ার পর আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে করার চেষ্টা করছি।’
তিনি লিখেছেন, ‘কিন্তু এর মধ্যে আমাকে মুখোমুখি হতে হয়েছে এক অবিশ্বাস্য অভিযোগের! আমি নাকি ফ্যাসিস্টের দোসর! যেই ফ্যাসিস্টকে তাড়ানোর জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাশে দাঁড়ালাম ১৬ জুলাই থেকে, অল আউট অ্যাটাকে গেলাম এটা জেনে যে ফ্যাসিস্ট হাসিনা টিকে গেলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যু অথবা জেল, আমি তারই সহযোগী?’
তিনি লিখেছেন, চেয়ারের জন্য কোনো সাফাই দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। কিন্তু শিল্পী হিসাবে অপমানিত বোধ করেছি বলেই কয়টা কথা বলছি। শাহবাগ আন্দোলন যখন শুরু হয় আর সবার মত আমিও ভেবেছিলাম এটা নির্দলীয়। যে কারণে আমার সব পোস্টে এটাকে ঠেলে ‘রাষ্ট্র মেরামত’ এজেন্ডার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কিছুদিন পরেই যখন বুঝে যাই, তখনই লিখি ‘কিন্তু এবং যদির খোঁজে’। যে কিন্তু এবং যদি শাহবাগ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর ইসলামকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে আজকের যে ফ্যাসিবাদের সূচনা করা হয়েছিলো তার প্রতিবাদে লিখি, ‘এই চেতনা লইয়া আমরা কি করিবো।’
২০১৪ সালে, এই দুইটা লেখার যে কোনো একটা লেখা ছাপা হওয়ার পর বিএনপির শিমুল বিশ্বাস সাহেব ফোন দিয়েছিলেন কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য। আমি কোনো দল করি না। কিন্তু আমি আওয়ামী লীগ হলে বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা আমার লেখায় কি খুঁজে পেলেন যে আমার সাথে পরিচয় না থাকা স্বত্বেও আমার নম্বর জোগাড় করে ফোন দিলেন?
আমি ঘটনাচক্রে একজন পরিচিত মুখ, ভাই ও বোনেরা। একজন লেখক যতোটা স্বাধীন ভাবে লিখতে পারেন, ফ্যাসিবাদের কালে আমার সেই স্বাধীনতা পাওয়ার সুযোগ ছিল না। তার মধ্যেও যতটুকু করেছি তার ফলও আমাকে ভোগ করতে হয়েছে। ২০১৫ সালে সেন্ট্রাল ইনভেস্টিগেশন সেলের হেনস্তার শিকার হওয়ার মধ্যে যে দীর্ঘ অত্যাচারের শুরু। সেই বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আমার সিমপ্যাথি পাওয়ার ইচ্ছা এবং প্রয়োজন নাই।
অনেকে বলছে, আমি ভারতীয় হেজেমনির অংশ। যে লোককে বাংলাদেশের কালচারাল এস্টাবলিশমেন্ট ঘৃণা করে আমি কোলকাতা কেন্দ্রিক ভাষার হেজেমনি ভেঙ্গে দিয়েছি বলে, সেই কিনা এই হেজেমনির অংশ!
আমি পৃথিবীর কোনো দেশেরই ঢালাও নিন্দা করি না। কারণ দেশে নানা চিন্তার মানুষ থাকে। আমি সবার সাথেই কথা বলতে চাই, কাজ করতে চাই। কিন্তু আমার দেশের ক্ষতি হলে, আমি তার বিরুদ্ধে বলতে কুণ্ঠা করি না। ফেলানীর মৃত্যুর পর কি পোস্ট দিয়েছিলাম ২০১৩ সালে সেটা দেখতে পারেন নিচে।
আমার অবস্থানের উপহার হিসেবে ভারতীয় হাই কমিশনে একসময় কর্মরত রন্জন মন্ডল নামের এক কর্মকর্তা তার ফেসবুকে পাবলিক পোস্ট দিয়ে বহুবার কি অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করেছিলো সেটা খোঁজ করে দেখুন। আর সেই আমি পার্ট অব হেজেমনি?
আমরা এক অনন্ত ভয়ের ঘরে বাস করে এসেছি। আমরা কথা বলতে ভয় পেতাম। এমনকি কথা বলার সময় ঘরে ফোন থাকলে সরিয়ে ফেলতাম। পাছে আড়ি পাতে। আমার মনে আছে, ২০১২ সালে শুধুমাত্র কথা বলার জন্য আমি আর ‘আরিফ আর হোসাইন’ লুকিয়ে আমেরিকান ক্লাবে গিয়ে বসে আলাপ করতাম কীভাবে এই জালিম সরকারকে হটানো যায়। বিএনপি এবং জামায়াত কিছু করতে পারবে? আর্মির মনোভাব কী? জোনায়েদ সাকির সাথে বাটন ফোনে কথা বলে গোপনে দেখা করতাম আর পরামর্শ করতাম কি করা যায়। সেই আমি আওয়ামী ফ্যাসিজমের পার্ট?
আমি তো কোনো বিপ্লবী নই। ছিলাম না কোনো কালে। আমি ফিল্মমেকার। ঘটনাচক্রে এবং আল্লাহর রহমতে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। আমি আমার সেই পরিচয়েই গর্বিত। আমি মারা গেলে আমাকে ফিল্মমেকার হিসাবেই মনে রাখা হবে, মন্ত্রী হিসাবে না। ফলে মন্ত্রিত্ব আমার কাছে কোনো অর্জন না, পাবলিক সারভেন্টের দায়িত্ব মাত্র।
আমি এটা ফাইনালি স্বীকার করেছি, নিজের ফিল্মের বাইরেও আমার দেশকে কিছু দেয়ার ক্ষমতা আল্লাহ দিয়েছে- এটা বিশ্বাস করেছি বলে। আমার মনে হয়েছে, জীবনের এই পর্যায়ে এসে নিজের লাভ-ক্ষতি না ভেবে এই ক্ষমতা দেশের কাজে লাগাই।