‘“ইতিহাস” সিনেমার পরে নয়, এখনো আমি ফ্ল্যাট, গাড়ি, বিদেশে নাশতার প্রস্তাব পাই’—কথাগুলো বললেন চিত্রনায়িকা রত্না কবির। কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘ইতিহাস’ সিনেমার পরে তুমুল আলোচনায় আসেন রত্না। তখন একসঙ্গে সাতটির মতো সিনেমায় শুটিং করতে হয়েছে। সেই সময়ে বড় বড় প্রযোজনাপ্রতিষ্ঠান ও বড় বাজেটের সিনেমায় নাম লেখান। নায়িকা হিসেবে সেই সময় থেকেই নানান রকমের বড় বড় প্রস্তাবের মুখোমুখি হতে হয়েছে রত্নাকে। সেগুলোকে কীভাবে মোকাবিলা করেছেন এই অভিনেত্রী?
রত্না বলেন, ‘দেখতে সুন্দরী আর ভালো ক্যারিয়ার থাকলে যেকোনো নায়িকাকে নিয়েই অনেক কথা হবে। এটা বাস্তবতা। কিন্তু সেগুলোকে কীভাবে দেখছেন, সেটাই আসল কথা। আমি যখন নায়িকা হিসেবে নাম লেখাই, সফলতা পাই, তখন থেকেই একের পর এক বাড়ি, গাড়ি, ঘুরতে যাওয়া, চা খাওয়ার প্রস্তাব পেয়েছি। “ইতিহাস” সিনেমার পরে নয়, এখনো আমি ফ্ল্যাট, গাড়ি, বিদেশে নাশতার প্রস্তাব পাই। কিন্তু সেগুলোকে শুরু থেকেই আমলে নেইনি। কেউ কোনো দিন বলতে পারবে না, আমি অন্যের টাকার প্রতি লোভ দেখিয়েছি।’
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বিভিন্ন রকম মানুষের সঙ্গে অভিনয়ের প্রয়োজনে মিশতে হয়েছে এই নায়িকাকে। শুরুতে সেগুলো বাছবিচার করতে না পারলেও একসময় খারাপ মানুষদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন। ‘আমাকে বললেই কেউ চা খাওয়াতে পারতেন না। এমনকি অনেক সময় সমুদ্রপাড়ে একটু হাওয়া খাওয়া, কোটি টাকার প্রস্তাবও আমার কাছে মূল্যহীন মনে হতো। তাদের কৌশলে এড়িয়ে চলতে হতো। তার চেয়ে আমার কাছের লোকের বাড়িতে দাওয়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম।’
তিনি অতীতের দিনগুলো নিয়ে আরও বলেন, ‘এই বাড়তি সময়টা আমি নিজের মতো করে পড়াশোনায় কাটিয়ে দিতাম। আমার কাছে সার্টিফিকেটটা অনেক মূল্যবান। সেটাই আমি অর্জনের পেছনে অভিনয়ের পাশাপাশি সময় দিয়েছি। নোংরা মানুষের সঙ্গে মিশি নাই। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ভালো। ১০ দিন কারও সঙ্গে কথা হলেই বুঝে ফেলতাম, তিনি খারাপ নাকি ভালো।’
এই অভিনেত্রী জানান, তিনি পরিবারের একমাত্র মেয়ে। শৈশব থেকে যা চেয়েছেন, তা-ই পেয়েছেন। যে কারণে অন্যের কোনো কিছুর ওপর লোভ তৈরি হয়নি। রত্না বলেন ‘আমি প্রায়ই আমার স্ট্যাটাসে আমার মনের কথাগুলো লিখি। এগুলো কিন্তু কঠিন কাজ। অনেকেই লিখতে পারবে না। কারণ, আমাদের প্রযোজক বা অন্যরা ঠিকই কিন্তু অন্য আইডি দিয়ে লিখে বেইমান। টাকা খেয়েছে। কিন্তু আমার এখানে চেক করে দেখেন, কেউ এমন কিছু লিখতে পারবেন না।’
এই নায়িকা জানান, অন্যরা তাকে নিয়ে কী ভাবছে, সেটা গুরুত্ব দেন না। তিনি বলেন, ‘নায়িকা হয়েও আমি বাবার কাছ থেকে স্কুল, কলেজের খরচ নিয়েছি। আর পারিশ্রমিক থেকে কিছু জমিয়ে মায়ের কাছে রাখতাম। সেটা দিয়ে বাড়ি, গাড়ি কিছুটা করেছি। এভাবেই চলছে আমার জীবন।’ ক্যারিয়ারে একটা সময় ভালো ছিল। দর্শক এখনো তাঁকে মনে করে, এটা তিনি আশীর্বাদ মনে করেন। তবে ব্যক্তিজীবনের বোধের জায়গায় তাঁর আক্ষেপ রয়েছে। এর কারণ, কখনো কখনো তিনি ভীষণ একা বোধ করেন।
রত্না ছিলেন পরিবারের একমাত্র মেয়ে। সাংবাদিক মা ও ইঞ্জিনিয়ার বাবার ব্যস্ততার কারণে বেশির ভাগ সময় কাটত নানির সঙ্গে। নানিই তাঁর দেখভাল করতেন। ‘আমি বড় হতে গিয়ে একটা সময় বুঝতে পারলাম, শৈশব থেকে অনেকটা সময় একা থাকার কারণে আমার কেনাকাটা, শপিং করা বা বাড়তি কোনো কিছুতে অভ্যস্ততা নেই। একসময় তো মা আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন। তখনো মার্কেটে যাওয়া, রেস্টুরেন্টে খাওয়ায় অত বেশি অভ্যস্ত হতে পারতাম না। একই ভাবে যখন শুটিং করতাম, তখনো সবাই অবাক হতো। এক সিনেমা থেকে আরেক সিনেমার শুটিংয়ে যাচ্ছি, কিন্তু নায়িকা হিসেবে কোনো খাবার বা বাড়তি কোনো কিছুই আমাকে টানত না। অবাক হতেন অনেকে। তাঁরা দেখতেন, আরে আমি এফডিসির ১০ টাকার মুড়ি খেয়েই খুশি। এটাই আমি।’
আপনি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, চাইলে আপনার দুই–চারটি বাড়ি–গাড়ি হতে পারত। তাহলে কি নায়িকা হয়ে বাড়ি–গাড়ি কোনো কিছুই করতে পারেননি? ‘তা করতে পারব না কেন? আমার বাড়ি–গাড়ি তো আছেই। একজন মানুষের যা দরকার হয়, তার সবই আমার আছে। আমি মিন করেছি, চাইলে বহু বাড়ি–গাড়ি–অর্থ থাকতে পারত। ফেসবুকে আরও কম লিখেছি। এগুলো আমাকে টানেনি। আমি শুটিং করে নিয়মিত মায়ের কাছে পারিশ্রমিকের সব টাকা একটু একটু করে জমাতাম। সেটা তো কম নয়’, বলেন তিনি।
কখনো কি অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন? সেই দিনগুলোর কথা বলবেন? ‘জীবন সব সময় একরকম চলে না। আমারও জীবনে ক্রাইসিস (সংকট) ছিল। আমার টাকার অভাব হয়েছে। তখন সিনেমার নায়িকা হয়ে মিউজিক ভিডিও, স্টেজের কাজগুলো করেছি। আমি জানি, আমার সঙ্গে এগুলো যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এসব কাজ করেই অর্থের অভাব দূর করতাম। এমন না যে তখন আমার কাছে বড় বড় প্রস্তাব আসত না। এ ছাড়া চাইলে অর্থ দেবে এমন অনেক আত্মীয়, পরিচিত প্রযোজকসহ অনেকেই ছিলেন। কেউ বলতে পারবেন না, আমি কারও কাছে সাহায্য চেয়েছি।’
সম্প্রতি রত্না একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রতি মাসে তাঁর ইউটিউবের জন্য চারটা করে নাটক বানাবেন। সেখানে এফডিসির যেসব সহকর্মীর কাজ নাই, বেকার, তাঁদের দিয়ে অভিনয় করাচ্ছেন। এমনভাবে রত্না কাস্টিং করেন, যেন কেউ কাজ করে চলার মতো অর্থ পান। রত্না বলেন, ‘আমি এফডিসিতে প্রবেশের পর সব সময় চেষ্টা করেছি আমার কাছের মানুষদের ভালো রাখতে। তাদের জন্য কিছু করতে। শুধু তা–ই নয়, আমি একইভাবে স্বামী, সংসারের জন্য কিছু করার চেষ্টা করি। স্বামীর কাছে কোনো দিন দামি শাড়ি–গয়না, এমনকি একটা নাকফুলও চাইনি। পারতপক্ষে বাজার–সদাইটাও যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে না বলে পারা যায় না, ততক্ষণে বলি। সারাজীবন আমি সবার জন্য সবকিছু করেছি ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। সেটা পেয়েছি কি না, সেই প্রশ্নই নিজেকে করি।’