৮১তম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সর্বোচ্চ পুরস্কার স্বর্ণসিংহ (গোল্ডেন লায়ন) জিতলেন স্প্যানিশ নির্মাতা পেড্রো আলমোদোভার। তার পরিচালিত ‘দ্য রুম নেক্সট ডোর’ সিনেমার জন্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এটাই তার পরিচালিত প্রথম ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র।
শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) রাতে ইতালির ভেনিস লিদো শহরে পালাৎসো দেল সিনেমা ভবনের সালা গ্র্যান্ড থিয়েটারে এবারের আসরের বিজয়ী তালিকা ঘোষণা ও পুরস্কার বিতরণ করা হয়। একই ভেন্যুতে গত ২ সেপ্টেম্বর ‘দ্য রুম নেক্সট ডোর’ দেখার পর দর্শক ও অতিথিরা টানা ১৭ মিনিট দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে অভিবাদন (স্ট্যান্ডিং ওবেশন) জানায়। ভেনিসের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ স্ট্যান্ডিং ওবেশনের মধ্যে এটি অন্যতম।
পুরস্কার গ্রহণ করে প্রতিক্রিয়ায় আলমোদোভার বলেন, ‘আমি এই পুরস্কার আমার পরিবারকে উৎসর্গ করতে চাই। এই সিনেমাটি ইংরেজিতে আমার প্রথম চলচ্চিত্র...তবে আত্মাটি স্প্যানিশ।’
‘দ্য রুম নেক্সট ডোর’-এর গল্পে ইউথানেশিয়া (স্বেচ্ছামৃত্যু) ও জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুগম্ভীর আবহ ছড়িয়ে আছে। জীবন, মৃত্যু ও বন্ধুত্বকে আলোকপাত করা হয়েছে এতে। এর মুখ্য দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন অস্কারজয়ী আমেরিকান দুই তারকা জুলিয়ান মুর ও টিল্ডা সুইন্টন। তাদের ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি পেদ্রো আলমোদোভার। স্বর্ণসিংহ গ্রহণের পর তিনি বলেন, ‘পুরস্কারটি তাদেরই প্রাপ্য। দুই নারীকে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্রটির গল্প। আর সেই দুই নারী হলেন জুলিয়ান ও টিল্ডা।’
দুই অভিনেত্রীর মাঝে পেড্রো আলমোদোভার। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের প্রথম সারির চলচ্চিত্র উৎসব পরিসীমায় প্রিয়জনের মতোই পেদ্রো আলমোদোভার। সাহসী, উদাসী ও হাস্যরসধর্মী বিষয়বস্তুর স্প্যানিশ-ভাষার চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ২০১৯ সালে তাকে ভেনিস উৎসবে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। ২০০০ সালে ‘অল অ্যাবাউট মাই মাদার’-এর সুবাদে সেরা বিদেশি ভাষার কাহিনিচিত্র বিভাগে অস্কার জয় করেন তিনি।
পেদ্রো আলমোদোভারের বয়স এখন ৭৪ বছর। তার মন্তব্য, স্বেচ্ছামৃত্যুকে রাজনীতি কিংবা ধর্ম দিয়ে অবরুদ্ধ করা উচিত নয়। ভেনিস উৎসবের সমাপনী মঞ্চে স্প্যানিশ ভাষায় তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, এই পৃথিবীকে নির্মলভাবে ও মর্যাদার সঙ্গে বিদায় জানাতে পারা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার।’
আমেরিকান নারী সাহিত্যিক সিগরিড নুনেজের ‘হোয়াট আর ইউ গোয়িং থ্রো’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছে ‘দ্য রুম নেক্সট ডোর’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। এতে ইনগ্রিড চরিত্রে জুলিয়ান মুর ও মার্থা চরিত্রে অভিনয় করেছেন টিল্ডা সুইন্টন। গল্পে দুই নারী একসময় বন্ধু ছিলেন, যারা নিজেদের কর্মজীবনের শুরুর দিকে নিউইয়র্কে একই ম্যাগাজিনে কাজ করতেন। ইনগ্রিড এখন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। তার বইয়ের কপি বিক্রি হয় লাখ লাখ। তবে ক্যানসারের কারণে জীবন সায়াহ্নে এসে পড়েছেন তিনি। এমন অবস্থায় মার্থার সঙ্গে আবারও যোগাযোগ গড়ে তোলেন ইনগ্রিড। মার্থা ছিলেন যুদ্ধের সংবাদদাতা। ব্যক্তিজীবনে অপূর্ণ একজন মা তিনি।
সনি পিকচার্স ক্ল্যাসিকসের পরিবেশনায় চলতি বছরের ২০ ডিসেম্বর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে ছবিটি।
ভেনিসে সেরা অভিনেত্রী হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান-আমেরিকান তারকা নিকোল কিডম্যান। তিনি ‘বেবিগার্ল’ চলচ্চিত্রে যৌন আকাঙ্ক্ষায় ডুবে থাকা দৃঢ়চেতা সিইও রোমি চরিত্রে তার অভিনয় বিচারকদের মন কেড়েছে। দাম্পত্য জীবনে স্বামীর সঙ্গে অসন্তুষ্টি থেকে অফিসের শিক্ষানবিশ তরুণ স্যামুয়েলের সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক গড়ে ওঠে রোমির। অসম বয়সী উদ্দাম প্রেমে জড়ানোর কারণে ক্যারিয়ার ও পরিবার উভয় দিক দিয়ে বিপাকে পড়ে এই নারী। যৌনতায় ভরপুর ছবিটিতে নারীর আকাঙ্ক্ষা ও অস্তিত্বের সংকট তুলে ধরা হয়েছে।
গত ৩০ আগস্ট সালা গ্র্যান্ড থিয়েটারে ‘বেবিগার্ল’ চলচ্চিত্রের বিশ্ব প্রিমিয়ারে ছিলেন নিকোল কিডম্যান। তবে মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাওয়ায় পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না ৫৭ বছর বয়সী এই অভিনেত্রী। ২০০২ সালে ‘দ্য আওয়ার্স’ ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রী বিভাগে অস্কার জিতেছেন তিনি। ‘বেবিগার্ল’ তাকে আবারও অস্কারে সাফল্য এনে দিতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
ফ্রান্সের ভাসোঁ লাদোঁ সেরা অভিনেতার ভলপি কাপ জিতেছেন। ফরাসি ভাষায় নির্মিত ‘দ্য কোয়ায়েট সান’ চলচ্চিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন তিনি। চরম ডানপন্থী মৌলবাদের কারণে বিচ্ছিন্ন একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে এর গল্প।
ইতালিয়ান নারী মাউরা দেলপেরো পরিচালিত ‘ভেরমিলিয়ো’ চমকে দিয়ে রানার-আপ পুরস্কার রৌপ্যসিংহ (সিলভার লায়ন) জিতে নিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইতালিয়ান আল্পসের পটভূমিতে ধীরগতির গল্প রয়েছে এতে।
সাড়ে ৩ ঘণ্টার চলচ্চিত্র ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’-এর জন্য সেরা পরিচালক হয়েছেন আমেরিকান নির্মাতা ব্র্যাডি কোরবেট। ৭০ মিলিমিটার সেলুলয়েডে চিত্রায়িত ছবিটির গল্পে হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে ফেরা হাঙ্গেরিয়ান এক ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রে জীবনকে নতুনভাবে শুরু করতে চায়।
সেরা চিত্রনাট্যকার পুরস্কার পেয়েছেন ব্রাজিলের মুরিলো হাউজার ও এইতর লরেগা। ব্রাজিলের পরিচালক ওয়াল্টার সালেসের ‘আই’ম স্টিল হিয়ার’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন তারা। এতে ব্রাজিলের সামরিক একনায়কতন্ত্র তুলে ধরা হয়েছে।
বিশেষ জুরি অ্যাওয়ার্ড জিতেছে জর্জিয়ার ডেয়া কলামবেগাশভিলি পরিচালিত ‘এপ্রিল’। এর গল্প অবৈধ গর্ভপাতের জন্য অভিযুক্ত এক প্রসূতি বিশেষজ্ঞকে কেন্দ্র করে।
ভেনিস লিদো থেকে খালি হাতে ফিরেছে টড ফিলিপসের বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র ‘জোকার: ফোলি আ দো’ (ওয়াকিন ফিনিক্স, লেডি গাগা)। এর আগের পর্ব ‘জোকার’ ২০১৯ সালে স্বর্ণসিংহ জিতেছিল।
ইতালির লুকা গুয়াদানিনো পরিচালিত ‘কুইয়ার’ ছবিতে সমকামী মাদকাসক্তের ভূমিকায় ড্যানিয়েল ক্রেগের অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। একইভাবে চিলির পাবলো লারাইনের পরিচালনায় গ্রিক অপেরা গায়িকা মারিয়া কালাসের বায়োপিক ‘মারিয়া’য় অ্যাঞ্জেলিনা জোলি সমালোচকদের মন কেড়েছেন। কিন্তু দুটি ছবিই কোনও পুরস্কার পায়নি।
এবারের আসরে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে স্বর্ণসিংহের জন্য লড়েছে ২১টি চলচ্চিত্র। মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের প্রধান বিচারক ছিলেন ৭১ বছর বয়সী ফরাসি অভিনেত্রী ইজাবেল উপের। তার নেতৃত্বে এবারের বিচারক প্যানেলে কাজ করেছেন চীনা অভিনেত্রী জাং জিয়ি, আমেরিকান পরিচালক জেমস গ্রে, ব্রিটিশ পরিচালক অ্যান্ড্রু হেইগ, পোলিশ পরিচালক আগনিয়েস্কা হলান্ড, ব্রাজিলিয়ান পরিচালক ক্লেবার মেনদোনচা ফিলু, মরিটানিয়ান পরিচালক আবদের রহমান সিসাকো, ইতালিয়ান পরিচালক জিউসেপ্পে তোরনাতোরে ও জার্মান পরিচালক ইউলিয়া ফন হাইঞ্জ।
বিশ্বের প্রাচীনতম এই উৎসব থেকেই হলিউডের আসন্ন পুরস্কার মৌসুমের দৌড় শুরু হয়ে থাকে। গত তিন বছরে ভেনিসে নির্বাচিত চলচ্চিত্র অস্কারে ৭৭টি মনোনয়ন পেয়েছে। এরমধ্যে ১৪টিতে জিতেছে। এবারও ভেনিসে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রের বেশিরভাগই অস্কারে ফেভারিট হয়ে উঠতে পারে।
গত ২৮ আগস্ট শুরু হয়েছিল ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব।