দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরলেন চলচ্চিত্রকার মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেই যোগ দিলেন এক চোখ ছলোছলো মিলনমেলায়। আবেগাত্মক সেই সন্ধ্যার কিছু অনুভূতি তিনি ভাগাভাগি করেছেন সামাজিক মাধ্যমে। জানিয়েছেন, ‘আমি “ভাই-ব্রাদারদের” প্রাউড ফাদার হয়ে তাকাইয়া থাকি আর আমার চোখ ভিজে আসে। এদের ছেড়ে আমি কবরে যাব কেমনে একা?’
‘ডুব’ সিনেমাটি যেবার বাংলাদেশ থেকে অস্কারে গেল, সে বছর, অর্থাৎ ২০১৮ সালে আমেরিকাভিত্তিক ম্যাগাজিন ভ্যারাইটির লেখক ম্যাগি লি ফারুকীকে নিয়ে এমন একটি বাক্য লিখলেন, যা বাংলাদেশের জন্য ছিল যথেষ্ট গর্বের। সিনেমাটিতে দেখানো সুখ, একাকীত্ব ও মনস্তত্ব প্রসঙ্গ টেনে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘ফারুকী প্রমাণ করেছেন, তিনি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের অনন্য কণ্ঠস্বর।’
গতকাল ছিল মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রযোজনা সংস্থা ছবিয়াল-এর ২৫ বছর পূর্তি উদযাপন। ছবিয়াল এক মামুলি প্রযোজনা সংস্থা নয়। একে একটি স্কুল বললে সহজে এর কার্যক্রম বোঝানো সহজ হবে। গতকাল যারা ২৫ বছর পূর্তির মিলনমেলায় হাজির হয়েছিলেন, তাদের ২৫ বছর আগের ও পরের মুখচ্ছবিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। শুধু তাই নয়, তাদের ‘হাতের’ও এসেছে পরিবর্তন। যে হাত দিয়ে তারা ছবিয়ালের জন্য ছবি বানাতেন, পরে অন্য প্রতিষ্ঠানের জন্য কিংবা নিজের জন্য, সেই হাতগুলো আরও চৌকস হয়ে উঠেছে। নেপথ্যে ছিলেন ‘ফাদার’ বা ‘িবগ ব্রাদার’মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
২৫ বছর! কত স্মৃতি, কত ঘটনা এসে জড়ো হতে থাকে ফারুকীর সামনে। সেসব বলে শেষ করার নয়। ওই আয়োজনে সবটা স্মরণ করাও সম্ভব নয়। তিলে তিলে গড়ে তোলা ছবিয়াল, ভুল করে শিখতে শিখতে এগিয়ে যাওয়া ফারুকীর ২৫ বছরের গল্পসম্ভার যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল কাল সন্ধ্যায়। কতগুলো মুখ সামনে এসে হাজির, রেদওয়ান রনি, আশফাক নিপুন, আদনান আল রাজীব, মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ ... একজন নেই, চলে গেছে পরপারে, হুমায়ুন সাধু! অনেকে এসে জড়ো হয়েছে শুভেচ্ছা জানাতে, শিহাব শাহীন, তানিম নুর, অনিম, শাওকী, নুহাশ, আরিফ, শঙ্খ, রাকা, রায়হান রাফি, অনম, রেজা, কারিনারা।
ছবিয়াল ২৫ বছর ধরে ছবি বানিয়েছে। চলমান ছবি, চলছবি। দেশসেরা বিজ্ঞাপন যারা বানিয়েছে এই সময়ে, ছবিয়াল তাদের অন্যতম। নাটক, সিনেমাও বানিয়েছে। সেখানে পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে ছবিয়ালকে। ১৯৯৮ সালে ছবিয়াল থেকে ফারুকীর প্রথম নির্মাণ ‘অয়েটিং রুম’ ফিকশনটি কোনো টিভি চ্যানেল কিনতে চায়নি। আজকের ছবিটা আলাদা। দেশসেরা মাধ্যমগুলোই কেবল সেরা দামে তাদের বানানো কাজ কেনার প্রস্তাব করে আজ। কারণ ফারুকীর নামের আগে যুক্ত হয়েছে ‘অান্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার’ শব্দগুচ্ছ।
মাঝখানের পথ সহজ ছিল না। ছবিয়াল থেকে ফারুকীর সাম্প্রতিক নির্মাণ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ দেখলে তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে। ফারুকী বলেন, ‘ছবিয়াল থেকে আমরা এমন সব সিনেমাই করতে চেয়েছি, যার মধ্যে বাংলাদেশর নিঃশ্বাস আছে।’ নিজস্বতা তৈরির এই চেষ্টাই অনন্য করে তুলেছে ছবিয়াল ও ফারুকীকে। এ যাত্রায় ছবিয়াল ও ফারুকীকে অনেকেই সাহায্য করেছেন। ফারুকী সেই নামগুলো ভুলতে পারেন না। সে রকম দুই নাম চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর ও চ্যানেল ওয়ানের কর্ণধার গিয়াস উদ্দিন আল মামুন।
ছবিয়ালের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ফরিদুর রেজা সাগর বলেন, ‘ব্যাচেলর সিনেমাটা বানানোর সময় ফারুকীর সঙ্গে আমার পরিচয়। সেই ফারুকী এখন কোন পর্যায়ে আছেন, তা দর্শকরা ভালো করেই জানেন। ফারুকী শুধু চলচ্চিত্র নির্মাতাই নন, সমাজের সবকিছু নিয়ে তার রয়েছে বিচার-বিশ্লেষণ। তাই ফারুকীর সিনেমায় আমরা আপনাকে আমাকে দেখতে পাই।’ ছবিয়ালের শুরুর দিকে সিরিজ চাওয়া হয়েছিল চ্যানেল ওয়ানের পক্ষ থেকে। সিরিজ না করে ‘ছবিয়াল উৎসব’ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ফারুকী। তখনকার কথা স্মরণ করে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস ছিল, আমাদের দেশের তরুণরা অনেক সুন্দর এবং নতুন কিছু করতে পারে। যার জন্য চ্যালেঞ্জটা আমরা নিই এবং সফল হই।’
দেশের বিনোদন অঙ্গনে ছবিয়াল আরও একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে, যে কারণে শুরুতে প্রযোজনা সংস্থাটিকে বলা হয়েছিল স্কুল। তরুণ নির্মাতা তৈরি করা। যারা একসময় সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন ছবিয়ালে, তারা এখন নিজেদের নামে খ্যাতিমান। অনেকে তাদের ‘ভাই-বেরাদার’ নামে চেনেন। তাদের অন্যতম রেদওয়ান রনি, আশুতোষ সুজন, শরাফ আহমেদ জীবন, আশফাক নিপুণ, ইফতেখার আহমেদ ফাহমী, মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ, আদনান আল রাজীব। স্মৃতিচারণ করে আশফাক নিপুন বলেন, ‘আমার নির্মাণে সবসময় লেখা থাকে – বানিয়েছেন, আশফাক নিপুন। সেই আশফাক নিপুনকে বানিয়েছে ছবিয়াল, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। আজ যতটুকু করতে পারি, তা ওই দুটি নামের জন্য।’ আরেক ‘বেরাদার’ ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকির প্রধান নির্বাহী রেদওয়ার রনি বলেন, ‘ছবিয়াল আমার এবং আমার মতো অনেকের আঁতুর ঘর। ছবিয়াল নিয়ে অল্প কথায় বলা যায় না, কারণ এটা খুব ইমোশনাল জায়গা, ইমোশনাল জার্নি। ছবিয়াল কোনো প্রতিষ্ঠান না, এটা একটা আতুর ঘর, আশ্রম।’
গত ২৫ বছরে অনেক কিছু নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে ফারুকী ও ছবিয়ালকে। সেসবের মধ্যে অন্যতম ভাষা নষ্ট করার অভিযোগ! নাটকে কথ্য ভাষার ব্যবহার করে রীতিমতো তোপের মুখে পড়েছিলেন ফারুকী। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘একসময় বুঝলাম অভিনয় মেকি লাগার অন্যতম কারণ ভাষা। আমি যেমন, কথাও যদি সেভাবে না বলি, তাহলে সেটা মেকি মনে হবেই। তাই আমি চরিত্রের ধরণ অনুযায়ী ভাষার ব্যবহার করেছি। দর্শক সেটা গ্রহণ করেছে।’
ছবিয়ালের উল্লেখযোগ্য ফিকশন ও ধারাবাহিক নাটকের মধ্যে রয়েছ ‘আয়শা মঙ্গল’, ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘কানামাছি, ‘চড়ুইভাতি, ‘৬৯’, ‘৫১বর্তী’, ‘৪২০’। সিনেমার মধ্যে ‘ব্যাচেলর’, ‘টেলিভিশন’, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’, ‘ডুব’, ‘পিঁপড়াবিদ্যা’।
ছবিয়ালের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজধানীর তেজগাঁওতে ওই মিলনমেলার আয়োজন করা হয়। যেখানে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীসহ ছিলেন ভাই-বেরাদেররা। অর্থাৎ তার তৎকালীন সহকারি পরিচালকেরা, সেই সহকারী পরিচালকদের সহকারি পরিচালকেরা। পরম্পরাকে সম্মান জানিয়ে এবং পরিবারের মানুষদের সঙ্গে নিয়ে তারা কাটিয়েছেন একটি আনন্দ সন্ধ্যা। ছবিয়ালের ২৫ বছর পূর্তিতে দর্শকদের উদ্দেশে ফারুকী বলেন, ‘২৫ বছর দর্শকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বড় হওয়া। আমি তো মনে করি, আমার সিনেমাগুলো সময়ের সঙ্গে যেমন কথা বলে, তেমন দর্শকের সঙ্গেও কথা বলে এবং এই কথা বলার মধ্যে দিয়েই আমরা বড় হচ্ছি, বুড়ো হচ্ছি। দর্শকরা আমাদের না ভালোবাসলে প্রথম সিনেমার পরই ছিটকে যেতাম। তারা যেভাবে আমাদের পথটাকে সমর্থন করেছেন, সেজন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।’
স্ত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফেসবুকে ফারুকী লিখেছেন, ‘স্পেশাল থ্যাংকস টু মাই ভাই-ব্রাদারস ফর অরগানাইজিং দিস। অ্যান্ড আ বিগ থ্যাংকস টু তিশা ফর এভরিথিং, এই বৃহৎ পরিবার আগলে রাখার আসল কারিগর। ও জানে আমি একা চলতে পারি না। ফলে ও সারাক্ষণ উপলক্ষ্য খোঁজে আমাদের গ্যাদারিংয়ের। আগে এইসব আয়োজনে আমি জড়িত থাকতাম। এখন তিশা আর ভাই-ব্রাদাররা আমাকে ঢুকতে দেয় না।’