প্রায় দুই শতাব্দি ধরে চলা মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য রক্ষায় চেষ্টা করে যাচ্ছেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার বামুনিয়া পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। একসময় এলাকার মাটির তৈরি করা পণ্যগুলো ছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয়। বর্তমানে শিল্পটি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া আর প্লাস্টিক, দস্তা, অ্যালুমিনিয়ামের আধিপত্যে মৃৎশিল্পের বাজারের অবস্থা নাজুক। তবে পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য রক্ষা করতে এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
জানা যায়, এ অঞ্চলের প্রাচীন মৃৎশিল্পী পরিবারগুলো প্রায় ২৫০-৩০০ বছর ধরে এ কাজ করে আসছে। তাদের সবার মুখে একটা কথাই শোনা যায়—‘আগের মতো আর কোনো কাজ চলে না, শুধু দইয়ের হাঁড়ির ভরসায় দিন কাটছে’। মাটি সংকট এ শিল্প টিকে থাকার আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাটি সংকটের কারণে মৃৎশিল্পীরা অনেক সময় নদী থেকে বিশেষ ধরনের আঁঠালো মাটি সংগ্রহ করেন, যা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য।
গ্রামের মৃৎশিল্পীরা বর্তমানে মাটির পাট এবং দইয়ের হাঁড়ি তৈরি করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। এতে তাদের চরম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। শ্রী গনেশ পাল নামের একজন মৃৎশিল্পী বলেন, ‘আগে আমরা বিভিন্ন ধরনের মাটির জিনিসপত্র তৈরি করতাম—হাঁড়ি, কলস, ঢাকনা, কাঁসা, পেল্লা, মাইসা, সাতখোলা; কিন্তু এখন শুধু দইয়ের হাঁড়ি আর মাটির পাটই বেচাকেনা হয়।’ একই সঙ্গে তপন কুমার নামের একজন মৃৎশিল্পী বলেন, ‘বর্ষাকালে মাটি সংগ্রহ করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। তবে চৈত্র-বৈশাখ মাসে মাটি কিনে কাজ চালিয়ে যাই।’
বামুনিয়া পালপাড়া গ্রামের প্রবীণ মৃৎশিল্পী নিত্যনন্দন পাল বলেন, ‘একসময় মাটির পাট তৈরি করে কুয়া বা ইন্দ্রা বানাতাম। এখন টিউবওয়েল হয়ে গেছে। তাই সে জিনিসের চাহিদা আর নেই। বৈশাখী মেলা কেন্দ্রীক মাটির কিছু জিনিস বেচাকেনা হয়। তবে তা দিয়ে সারাবছর চলে না। দইয়ের হাঁড়ি তৈরির জন্য কিছুটা চাহিদা আছে। দিনে এসব হাঁড়ি বিক্রি হয় ৬-১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। যা ভালো আয় হিসেবে কাজ করে। দইয়ের হাঁড়ি ছাড়াও অন্য জিনিসপত্রের চাহিদা মারাত্মকভাবে কমে গেছে।’
পালপাড়া গ্রামের মিনতি বালা বলেন, ‘আমাদের ৮ সদস্যের পরিবার এ কাজের মাধ্যমেই চলে। আগে নানা ধরনের মাটির জিনিস তৈরি করতাম। এখন সেগুলোর কোনো চাহিদা নেই। শুধু দইয়ের হাঁড়ি আর ঢাকনা বানানোর মাধ্যমে যা রোজগার হয়, সেটাও যথেষ্ট নয়। একসময় মাটির হাঁড়িতে ভাত খাওয়ার স্বাদ ছিল আলাদা। এখন প্লাস্টিক বা সিসার হাঁড়ি বাজার দখল করেছে। গ্যাসের চুলা এবং রাইস কুকারের কারণে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের প্রতি আগ্রহ কমে গেছে।
গ্রামের মৃৎশিল্পীরা দাবি করেছেন, মানুষ এখন বিলাসিতা ও আরামের দিকে ঝুঁকেছেন। তাই মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা দিন দিন কমছে। যদি সরকার তাদের সুদমুক্ত ঋণ দেয়, তাহলে তারা ব্যবসা আরও বাড়াতে পারবেন। সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে খুব দ্রুতই মৃৎশিল্প বিলুপ্তির পথে চলে যাবে। হয়তো একসময় শুধু ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে।
শ্রী গনেশ পাল বলেন, ‘যদি আমাদের কাজের জন্য সুদমুক্ত ঋণ পাওয়া যায়। তাহলে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সহজ হবে। আমাদের এলাকায় যে মাটির দাম বেড়ে গেছে, সেই দাম কমানোর চেষ্টা যদি হয়; তবে আরও ভালোভাবে এই পণ্য তৈরি করা সম্ভব হবে।’
মৃৎশিল্পের এই সংগ্রাম শুধু বগুড়ার পালপাড়া নয়, দেশের বহু গ্রামীণ অঞ্চলে দেখা যায়। বিশেষত, যখন আধুনিকতার দাপটে প্রাচীন শিল্পগুলো হারিয়ে যাচ্ছে; তখন মৃৎশিল্পীরা তাদের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করছেন।