শীতে পরিযায়ী পাখিরা কীভাবে সহস্র মাইল পথ চিনে যায়-আসে?

ফিচার ডেস্ক
  ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:৩৩

প্রতিবছর শীতকালে নানা ধরনের পরিযায়ী পাখি আমাদের দেশে আসতে দেখা যায়। এই পরিযায়ী পাখিগুলো হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে, বিপুল দূরত্ব অতিক্রম করে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। শীতের আগমন শীতপ্রধান অঞ্চলের পাখিদের জন্য এক প্রাকৃতিক অবস্থা, যা তাদের জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাইবেরিয়া বা রাশিয়া থেকে আসে ওয়েডার্স ও ডাক। ইউরোপ থেকে আসে ইউরোপিয়ান ফ্লাইক্যাচার, ব্রাউন-ব্রেস্টেড ফ্লাইক্যাচার, বার্ন সোয়ালের মতো আরও কত সব পাখি! খাবারের অভাব কিংবা প্রজননের সমস্যার মতো নানা কারণেই তাদের এই ‘অনন্ত’ সফর। তবে আসল কারণ হয়তো উষ্ণতা। এই সময়ে আসা। আর মার্চ-এপ্রিলের দিকে ফিরে যাওয়া। এটাই তাদের সারা বছরের রুটিন।
তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো-এই পাখিরা কীভাবে এত দীর্ঘ পথ চিনে আসে? তাদের এই দূরপাল্লার যাত্রার পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে?
পরিযায়ী পাখিদের দীর্ঘ যাত্রা সম্পন্ন করতে সাহায্য করে তাদের অভ্যন্তরীণ নেভিগেশন সিস্টেম। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পাখিদের মধ্যে একটি প্রাকৃতিক কম্পাস রয়েছে যা তাদের সঠিক দিক নির্দেশ করতে সক্ষম। পাখিরা তাদের যাত্রার পথে সূর্য, তারকা, চাঁদ এবং পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সাহায্যে দিক নির্ধারণ করে। বিশেষ করে পাখিরা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন অনুভব করতে সক্ষম, যা তাদের সঠিক দিক নির্ধারণে সাহায্য করে। এই চৌম্বক ক্ষেত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে তারা তাদের যাত্রাপথের অভ্যন্তরীণ স্মৃতিকে কাজে লাগিয়ে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে।
বিজ্ঞানীরা একটি পরীক্ষায় দেখেছেন যে, পাখিরা মহাকাশের তলা থেকে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সিগন্যাল ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করে। এটি একটি প্রাকৃতিক ‘জিপিএস সিস্টেম’ হিসেবে কাজ করে, যা পাখিদের যাত্রার পথে সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়। পাখির শরীরে বিশেষ ধরনের সেল থাকে, যা চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রতি সংবেদনশীল এবং তা পাখিদের চলাচলের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সেলের মাধ্যমে তারা পৃথিবী থেকে আসা চৌম্বক তরঙ্গ অনুভব করে এবং তাদের যাত্রাপথে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য ব্যবহার করে।
পাখিরা যে যাত্রাপথ অনুসরণ করে, তা তাদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতা ও অভ্যাসের ওপর নির্ভর করে। পাখিরা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট এলাকার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে থাকে। তারা পূর্ববর্তী যাত্রায় যে পথে চলেছিল, তা পুনরায় চিনে নিয়ে ফেরত আসে। ফলে একটি অতিথি পাখি যখন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে চলে আসে, তখন সে একই পথে ফিরে আসার অভ্যাস অর্জন করে। এভাবে পাখিরা পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজেদের পথ চিনে নিতে পারে। এছাড়া নতুন পাখিরা অভিজ্ঞ পাখিদের অনুসরণ করে পথ চিনে নেয়, যা তাদের যাত্রার সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাখিদের অভিবাসনের সময়সূচি এবং পথেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেমন-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা ও আবহাওয়া পরিবর্তন পাখিদের অভিবাসনকে প্রভাবিত করে। গবেষণা অনুযায়ী, পাখিরা আবহাওয়ার পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রেখে তাদের অভিবাসনের সময়সূচি নির্ধারণ করে, যাতে তাদের খাদ্য ও আশ্রয়ের অভাব না হয়।
পরিযায়ী পাখিরা শুধু দীর্ঘ পথ পারি দেয় না, তারা বিভিন্ন কৌশলও ব্যবহার করে যাত্রার সঠিকতা নিশ্চিত করতে। একে বলা হয় ‘ফ্লক ফ্লাইং’ বা ঝাঁকভাবে উড়ান। পাখিরা একত্রে দলবদ্ধ হয়ে উড়ে, যার ফলে তাদের পথ অনুসরণ করা সহজ হয় এবং তারা একে অপরের কাছ থেকে সঠিক দিক নির্দেশনা পায়। একই সঙ্গে তাদের গতি নিয়ন্ত্রণও সম্ভব হয় এবং ক্লান্তি কম হয়। এতে করে পাখিরা আরও দ্রুত এবং সঠিকভাবে তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাখির অভিবাসন নিয়ে গবেষণা করেছেন। স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং এবং রেডিও ট্রান্সমিটার পাখির দেহে স্থাপন করে, তাদের চলাচল ও অভিবাসন পথ অনুসরণ করা হয়। এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন, পাখিরা কখন এবং কোথায় বিশ্রাম নেয়, এবং কীভাবে তারা বিপুল দূরত্ব পাড়ি দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়। এসব তথ্য পাখির অভিবাসনকে আরও ভালোভাবে বোঝার পথ খুলে দিয়েছে।