শ্রীমঙ্গল উপজেলার দুই নম্বর ভুনবীর ইউনিয়নের মাধবপাশা গ্রামে অবস্থিত সাতগাঁও পরগনার প্রাচীন সাতগাঁও বাজার। এক সময় বাংলাদেশ তথা সিলেটজুড়ে যাতায়াত ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ।আর সাতগাঁও অঞ্চলের নৌঘাট ছিল মতিগঞ্জ বিলাস নদীর তীরে ফুলছড়ি ঘাট। তখন বিলাস নদীর গভীরতা ছিল অনেক। জাহাজ লঞ্চ নৌকা চলাচল করত কলকাতা পর্যন্ত বিলাস নদী দিয়ে। বিট্রিশ সরকার সহজ আধুনিক যাতায়তের জন্য সিলেটজুড়ে রেল লাইন নির্মাণ করেন। শ্রীমঙ্গল উপজেলায় দুটি রেল স্টেশন তৈরী হয় শ্রীমঙ্গল আর সাতগাঁও রেল স্টেশন। সাতগাঁও রেল স্টেশনের প্রয়োজনীয়তা ছিল সাতগাঁও অঞ্চলের মির্জাপুর চা বাগান, সাতগাঁও, আমরাইল ছড়া, গান্ধী ছড়া, হুগলিয়া ছড়, মাকরিয়া ছড়া চা বাগানে উৎপাদিত চা পাতা চট্টগ্রামে প্রেরণের জন্য।
সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রেল চলাচল শুরু হয়। চা পাতা গুদামজাত করার জন্য বিট্রিশ সরকার শুধু চা পাতার জন্য মির্জাপুর চা গুদাম নির্মাণ করেছিল। কয়েক বছর আগে সাতগাঁও রেলওয়ে স্টেশনের সেই গুদাম ঘরটির অব্যবহৃত থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে গেছে এখন আর অবশিষ্ট নাই। যেহেতু সড়ক পথ উন্নত ছিল না তাই সাতগাঁও অঞ্চলের মানুষ ট্রেনে ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়ত করতেন। এখন সাতগাঁও রেল স্টেশনের সেই জুলুস আর নাই। সাতগাঁও রেলওয়ে স্টেশনটি কোন রকম ঠিকে আছে। রেল পথ ঘিরে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সাতগাঁও পোস্ট অফিসের।
মতিগঞ্জ বিলাস নদীর পাড়ে মতিগঞ্জ বাজার প্রবল ভূমিকম্পে বিলীন হলে বাজার চলে আসে সাতগাঁও রেলস্টেশনের
পাশে। বাজারটি শ্রীমঙ্গল বাজারের কাছাকাছি হওয়ায় যতটা বর্ধিত হওয়ার দরকার ছিল তা হয়নি। সাতগাঁও বাজারটি সপ্তাহের প্রতিদিনই হাট বসে। এখানে সবকিছু পাওয়া যায়। রয়েছে মাছ বাজার, সবজি বাজার, পান বাজার, চাল বাজার, লাকড়ির বাজার, শুটকির বাজার, জুতা সেলাইয়ের মুচি বাজার। কয়েক শত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রাস্তার দুই পাশে গড়ে উঠেছে। আছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের শাখা ও কয়েকটি এনজিও অফিস। ছোট বাজার হলেও রয়েছে অসংখ্য ওষুধের দোকান ফার্মেসি। এক সময় বাজারের বিখ্যাত পল্লী চিকিৎসক ছিলেন ডাক্তার জিতেন্দ্র শর্মা, ডাক্তার ধীরেন্দ্র দেব, ডাক্তার বিজয় দেব, ডাক্তার আবুল বাশার, ডাক্তার সুফী, ডাক্তার জলিল, ডাক্তার সিরাজ, ডাক্তার ওহাব খান প্রমুখ।
বাজারের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ছিলেন ধীগেন্দ্র বাবু, মনহর হাজী, ক্ষীতেশ সরকার, কাজী ফুল মিয়ার রেস্টুরেন্ট, লাল মিয়ার চায়ের দোকান, সুকুমারের চায়ের দোকান, মনিলাল হালইর জিলাফির দোকান। বাজারে রয়েছে চারটি মসজিদ সাতগাঁও বাজার জামে মসজিদ ও রেলওয়ে জামে মসজিদ, সামাদিয়া মাদ্রাসা জামে মসজিদ ও নতুন বাজার জামে মসজিদ।বাজারের শেষ প্রান্ত শ্রীমঙ্গল রোডে হাজী আব্দুস সামাদ প্রতিষ্ঠিত সামাদিয়া আলিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদ যা বাজারের গুরুত্ব বাড়িয়েছে অনেক গুণ। বাজার জামে মসজিদের পাশে গড়ে উঠেছে সাতগাঁও বাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নতুন বাজার মাধবপাশা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাজারের চাল হাঁটার পিছনে ছিল বিরাট এক বড় পুকুর, যেখানে বিভিন্ন সময়ে সাঁতার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। বাজারের পাশে নতুন বাজারে আছে ফুটবলের বিরাট মাঠ। বিকাল বেলা প্রতিদিন মাঠে খেলাধূলা হত। বাজার ঘিরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পিপলস স্পোটিং ক্লাব, রেলস্টেশনের পাশে ছিল অফিস ঘর। ক্লাবের উদ্যোগে বিভিন্ন সময় নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল অনেক দিন ধরে। পালন হত জাতীয় দিবস ও বৈশাখী মেলার। আর ওসমানী স্পোটিং ক্লাব। ক্লাবের অনেক সদস্য ব্যক্তি জীবনে জীবিকার থাকিতে চাকুরী বা বিদেশ চলে গেলে পিপলস ক্লাবের ইতি ঘটে। বাজারের ব্যবসায়ীদের নিয়ে ছিল বাজার সমবায় সমিতি এখন আর তার কোন অস্তিত্ব নাই।
চাল বাজারে খান সাহেবের ঘরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রোজিনা সিনেমা হল। পরবর্তী আন্দোলনের মুখে রোজিনা সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে বাজারটি সরকারীভাবে ইজারা দেওয়া হয়। প্রতি বছর ইজারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়ে থাকে। যেভাবে বাজারে জনবসতি বাড়ছে বাজারের চতুর্দিকের এলাকা নিয়ে সাতগাঁও পৌরসভা করা সম্ভব হবে। অবশ্য সে জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন ছাড়া সম্ভব নয়।
অদূর ভবিষ্যতে এক দিন হয়তো এলাকাবাসীর আন্তরিক সহযোগিতায় সাতগাঁও পৌরসভা বাস্তবায়ন হবে। পুরো মাধবপাশা গ্রাম, লইয়ারকুলের সাতগাঁও চৌমুহনা পর্যন্ত সীমানা নিয়ে সহজে সাতগাঁও পৌরসভা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সাতগাঁও রেল স্টেশনে আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রা বিরতি হলে সাতগাঁও বাজারের গুরুত্ব বেড়ে, শ্রীমঙ্গল শহরের বিকল্প উপশহর হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেত। সাতগাঁও বাজার পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হল- বাজারের বৃহৎ জমি হল রেলওয়ের মালিকানা। যার ফলে জমির মালিকানার জটিলতায় কোন রকমের বড় স্থাপনা নির্মাণ করা যাচ্ছে না। বাজারের নিজস্ব জমি না থাকাতে বাজার প্রতিষ্ঠার এত বছর পরও আশানুরূপ উন্নয়ন নেই বা সরকার করতে পারছে না।
বাজারের ঐতিহ্য ছিল চা পাতা ব্যবসায়। এক সময় সাতগাঁও বাজার চা পাতার ব্যবসায়ের জন্য উপজেলার মধ্যে বিখ্যাত ছিল। চা পাতা ব্যবসায়কে কেন্দ্র করে চা পাতা গুদাম ঘরের শ্রমিক হিসেবে এলাকার দরিদ্র অনেকেই চা পাতা গুদাম ঘরে কাজের উপর জীবিকা নির্বাহ করতেন। মোস্তফার রাইস মেইলে সারা রাত বিভিন্ন চা বাগান থেকে সংগ্রহ করে আনা চা পাতা কোটানো হত। গুদাম ঘর হিসেবে পরিচিত ছিল বাজারের শুরুতে পুরানগাওয়েল মানিক মিয়ার মালিকানা লম্বা গুদাম ঘর, আরও কয়েকটি ঘর। যার জন্য প্রায়শই নকল চা পাতা উদ্ধারের জন্য তৎকালিন বিডিআরের তৎপরতা লক্ষ্য করা যেত। চা পাতা ব্যবসায়ীদের অন্যতম ছিলেন প্রবীণ সেন, এসকে রায়, আজিজ খান, চৌধুরী, খালেক মিয়া সর্দার, ইজরাগাওয়ের আব্দুস ছাত্তার প্রমূখ। চা পাতা ব্যবসায় করে অনেকেই আয় উপার্জন করেছিলেন। সাতগাঁও রেলস্টেশন
থেকে মাল বুকিং করে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বিক্রি করতেন।
বাজারের রেলস্টেশনের পাশে ভোজপুর রোডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইউনুছ শাহ পাগলার মাজার। এখানে প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত হাজার হাজার ভক্তবৃন্দের আয়োজনে উরস অনুষ্ঠিত হয়। উরসে আসা মানুষ জনের জন্য গরু জবাই করে শিন্নি রান্না করে সবাইকে খাওয়ানো হয়। বসে আনন্দ উৎসবের বিরাট মেলা, বিভিন্ন দোকান ও খেলাধুলার রাইড। ইউনুছ পাগলার উরস এখন এলাকার অন্যতম ঐতিহ্যের রুপ নিয়েছে। তিন দিনব্যাপী উরসকে ঘিরে এলাকার মানুষসহ আশেপাশের মানুষের সমাগমে মূখরিত হয় মাজার প্রাঙ্গণ। চলে অতিথি শিল্পীদের পরিবেশনায় গান বাজনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এক সময় সাতগাঁও রেলস্টেশনে চাঁদপুর থেকে রেল যুগে প্রচুর ইলিশ মাছ আসত এবং রেল থেকে খালাস করে পুরো সিলেট অঞ্চলে এখান থেকে পাঠানো হত। প্রচুর মাছ আসার কারণে এলাকার লোকজন সস্তায় ইলিশ মাছ কিনতে পারতেন। এ বিষয়টি এখন অবশ্য নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা। বিভিন্ন কারণে সাতগাঁও রেলস্টেশনে চাঁদপুর থেকে ইলিশ মাছ আসা বন্ধ হয়ে যায়।
সাতগাঁও রেলস্টেশন থেকে রেল গাড়িতে পানি সরবরাহ করা হত। পানির সুব্যবস্থা ছিল। সুপীয় পানির জন্য রেল স্টেশনের পাশে লাহারপুরের দিকে একটি গভীর পানির কোঁয়া ছিল। যেহেতু রেলস্টেশন সেজন্য রেল মাস্টার, পাইটম্যান, রেললাইন রক্ষণাবক্ষণ কর্মীদের জন্য কোয়ার্টার ছিল। বেশীর ভাগ বিট্রিশ সরকার কতৃক নির্মিত বিল্ডিংগুলি আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। সময় ও কালের সাথে সাথে সবকিছুতে পরিবর্তন হয়েছে। লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। আজ গ্রামের পরতে পরতে শহরের ছোঁয়ায় নগর সভ্যতায় কত প্রাচীন ইতিহাস হারিয়ে গেছে সাতগাঁও অঞ্চল থেকে। ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে সেসব স্মৃতিগুলি।
লেখক: শেখ শফিকুর রহমান, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র