কিউবায় যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত গুয়ানতানামো বে বন্দীশালাটির বয়স আজ ১১ জানুয়ারি ২৩ বছর পূর্ণ হলো। তবে এখানকার সাবেক বন্দী মানসুর আদায়ফি মনে করেন, এ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আসলে ২৩ বছরের ‘অবিচার, আইনহীনতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, নির্যাতন ও অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখার’ সংস্কৃতিরই নামান্তর।
গুয়ানতানামো বে কারাগারটি গিতমো নামেও পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের এ সামরিক কারাগারে একসময় প্রায় ৮০০ মুসলিম পুরুষকে বন্দী রাখা হয়েছিল। এখন মাত্র ১৫ জন বন্দী আছেন। বন্দীদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় কারাগারটি বন্ধে সোচ্চার থাকা মানুষেরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। তাঁদের আশা, এটি বন্ধ হবে, সেই সঙ্গে ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে।
সাবেক বন্দী আদায়ফি এখন পরামর্শক গ্রুপ কেজ ইন্টারন্যাশনালের গুয়ানতানামো প্রকল্পে সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর মতে, গিতমো কারাগারটি বন্ধ হলে, তার মানে হবে বন্দীদের প্রতি ন্যায়বিচার করা।
আল জাজিরাকে আদায়ফি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই ভুল স্বীকার করতে হবে। ভুক্তভোগী, বেঁচে যাওয়া মানুষদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে।’ যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষতিপূরণ দিতে ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারসহ কয়েকটি স্থাপনায় হামলার জবাবে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু করেছিল ওয়াশিংটন। এ যুদ্ধে বন্দী হওয়া ব্যক্তিদের রাখতে ২০০২ সালে গুয়ানতানামো বে কারাগার চালু করা হয়। আল কায়েদা ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগসূত্র থাকার সন্দেহে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেককে বন্দী করা হয়েছিল। গুয়ানতানামো বে কারাগারে পাঠানোর আগে অনেককে গোপন বন্দীশালায় রেখে ভয়াবহ নির্যাতন করা হতো।
গুয়ানতানামোর বন্দীদের আইনি লড়াই চালানোর মতো অধিকার খুবই কম। এমনকি সামরিক কমিশন নামে গুয়ানতানামোর বিকল্প বিচারব্যবস্থার আওতায় কেউ মুক্তি পেলেও, তাঁদের বছরের পর বছর বন্দী রাখা হতো। তাঁরা তাঁদের আটকে রাখাকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ পাননি।
৯/১১ হামলাপরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসীদের ধরার নামে মুসলিমদের ওপর যে ভয়াবহ নিপীড়ন চালিয়েছে, এ কারাগার তারই প্রতীক।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন গুয়ানতানামো কারাগার থেকে বন্দীদের বের করার তৎপরতা জোরদার করেছে। আগামী ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইয়েমেনের ১১ বন্দীকে মুক্তি দিয়ে তাঁদের ওমানে পুনর্বাসন করেছে। গত মাসে দুজন বন্দীকে তিউনিসিয়া ও কেনিয়ায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের যুক্তরাষ্ট্র শাখার ‘সিকিউরিটি উইথ হিউম্যান রাইটস’ কর্মসূচির নিরাপত্তা পরিচালক ড্যাফনি ইভিয়েটার বলেছেন, গুয়ানতানামো বে বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব। তাঁর মতে, এখনো যে বন্দীরা রয়ে গেছেন তাঁদের অন্য দেশে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তর করে মার্কিন বিচার ব্যবস্থার আওতায় আনা যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে গিতমোর বন্দীদের স্থানান্তরের ওপর ২০১৫ সালে একটি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কংগ্রেস। তবে ইভিয়েটারের বিশ্বাস, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে কাজ করতে পারে হোয়াইট হাউস, বিশেষ করে হাতে গোনা যে কয়েকজন বন্দী ওই কারাগারে আছেন, তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে পারে।
গুয়ানতানামো সম্পর্কে ইভিয়েটার বলেন, ‘এটা আইনহীনতা ও ইসলামোফোবিয়ার (ইসলামবিদ্বেষ) একটা প্রতীক।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো ধরনের অভিযোগ ও বিচার ছাড়াই এত মানুষকে অধিকারবঞ্চিত করে এত দীর্ঘ সময় যে আটকে রেখেছে, তা ভয়াবহ। বাস্তবতা হলো, ২৩ বছর পর এখনো যে এটা চলছে, এটা পাগলামো।’
২০০৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার চলাকালে তৎকালীন ডেমোক্রেটিক প্রার্থী বারাক ওবামা কারাগারটি বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর পরিকল্পনার ঘোর বিরোধিতা করেন রিপাবলিকানরা। ওবামা দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিকে কারাগারটি বন্ধ করতে না পারা নিয়ে অনুশোচনা করেছিলেন।
মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগন বলেছে, গিতমো বন্দিশালায় আটক ১৫ জনের মধ্যে তিনজন ছাড়া পাওয়ার যোগ্য। আরও তিনজনকে গুয়ানতানামোর পিরিওডিক রিভিউ বোর্ডের সামনে হাজির করা হতে পারে। ওই বন্দীদের স্থানান্তর করাটা নিরাপদ কি না, তা রিভিউ বোর্ড পর্যালোচনা করবে।
ইভিয়েটার আল জাজিরাকে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতা ছাড়ার আগে আরও বন্দীকে স্থানান্তর করতে পারবেন বলে আমরা আশাবাদী।’ যদিও নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর আগে কারাগারটি খোলা রাখবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন।
সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে সোচ্চার সংগঠন ফ্রেন্ডস কমিটি অন ন্যাশনাল লেজিসলেশন (এফসিএনএল) মনে করে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার আগে বাইডেনকেই কারাগারটি বন্ধ করে দিতে হবে।
এফসিএনএলের সমরশক্তি ও মানবাধিকারবিষয়ক প্রোগ্রাম অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেভরা ব্যাক্সটার একটি বিবৃতিতে বলেন, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গুয়ানতানামো বন্ধ করার ঘোর বিরোধিতা করেছেন। এ জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পক্ষ থেকে কারাগারটি বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়াটা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি।
ডেভরা মনে করেন, এ পর্যন্ত কোনো ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা ছাড়া ও অভিযোগের স্বীকারোক্তি দেওয়া বিষয়ে চুক্তি না করে যে তিনজনকে আটকে রাখা হয়েছে, তাঁদের স্থানান্তরের মধ্য দিয়েই শুধু গুয়ানতানামো বন্ধ হতে পারে।
তবে গুয়ানতানামোর বন্দীদের সঙ্গে এমন চুক্তি করার পরিবর্তে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ৯/১১-এর ওই তিন সন্দেহভাজনের সঙ্গে ইতিমধ্যে হওয়া একটি সমঝোতা বাতিল করতে চাইছেন। সামরিক কৌঁসুলিদের সঙ্গে বন্দীদের ওই সমঝোতা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বন্দীরা দোষ স্বীকার করলে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।
আদালত এখন ওই সমঝোতার বৈধতা ও এর বিরুদ্ধে অস্টিনের ভেটো মূল্যায়ন করছেন।
ইভিয়েটার বলেছেন, অস্টিনের পদক্ষেপ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শামিল। তিনি বলেন, ‘এটা এক উদ্ভট পরিস্থিতি। আমি বুঝতে পারছি না যে এমনটা কেন হলো। বাইডেন প্রশাসন বলেছে যে, তারা গুয়ানতানামো বন্ধ করতে চায়, আবার প্রতিরক্ষামন্ত্রী এখানে নাক গলাচ্ছেন ও সমঝোতা বাতিল করার কথা বলছেন।’
কেজ-এর গুয়ানতানামো প্রকল্পের সমন্বয়ক আদায়ফি বলেন, বন্দীদের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে যে ধরনের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায়, গুয়ানতানামোতে কোনো বিচারব্যবস্থা কার্যকর নেই।
আদায়ফি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতাদর্শ ধারণ কিংবা গুয়ানতানামোকে ধারণ করতে পারে। তবে দুটোকে একসঙ্গে ধারণ করতে পারে না।
সাবেক এই বন্দী বলেন, ‘আমার ধারণা, তারা গুয়ানতানামোকে ধারণ করে।’
আল জাজিরা