আরব্য মরুভূমিতে দুঃসাহসিক তিন নারী অভিযাত্রী

ফিচার ডেস্ক
  ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২২:৫১

নারীরা আজ বিশ্বময় ভ্রমণ করছেন। ছুটে বেড়াচ্ছেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ইতিহাসজুড়ে বহু সাহসী নারী সমাজের ধরাবাঁধা নিয়মকে উপেক্ষা করে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন। পৃথিবীবাসীদের জানিয়েছেন বহু অজানা রহস্য। তাদের অদম্য শক্তি এবং অতৃপ্ত কৌতূহল অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছে বহু ভ্রমণপিপাসুদের। আজ এমনই দুঃসাহসিক তিন নারী অভিযাত্রীর সঙ্গে পরিচিত হব যারা নারী ভ্রমণকারীদের পথিকৃৎ। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণের নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।
 
গারট্রুড বেল

গারট্রুড বেল ছিলেন একজন ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক, লেখক এবং অভিযাত্রী। আরব্য মরুভূমিতে বেলের সাহসী অভিযান এবং গবেষণা ভ্রমণের জগতে অনন্য অবদান রেখেছে। তাকে বলা হয় ‘কুইন অব দ্য ডেজার্ট’।
বেলের জন্ম ১৮৬৮ সালের ১৪ই জুলাই, ইংল্যান্ডের কাউন্টি ডারহামে। ছোটবেলা থেকেই অজানাকে জানার অতৃপ্ত কৌতূহল এবং তৃষ্ণা ছিল তার।
ইংল্যান্ডে জন্ম হলেও মধ্যপ্রাচ্যের প্রত্নতত্ত্ব এবং সংস্কৃতির প্রতি গভীর আকর্ষণই তাকে সমগ্র বিশ্বজুড়ে অসংখ্য অভিযানে নামতে সাহায্য করেছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তৃত ভ্রমণ এবং স্থানীয় বেদুইন সম্প্রদায়ের সঙ্গে গভীর সংযোগ তাকে ওই অঞ্চলের মানুষ, ইতিহাস এবং রাজনীতি সম্পর্কে একটা সুনির্দিষ্ট ধারণা দেয় যা পরবর্তীতে তার লেখালেখিতে গভীরভাবে ফুটে ওঠে। শুধু ভ্রমণই নয়, আরবিতে সাবলীল হওয়ায় এবং প্রখর বুদ্ধিমত্তার কারণে বিভিন্ন উপজাতীয় নেতা, রাজনীতিবিদ এবং পণ্ডিতদের সঙ্গে তার গভীর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল—পরবর্তীতে যা মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ নীতি গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই অঞ্চল সম্পর্কে বেলের বিস্তৃত জ্ঞান, জটিল রাজনৈতিক গতিশীলতার সঙ্গে তার নিজস্ব উপলব্ধি তাকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্মকর্তাদের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা হতে সাহায্য করে।
ভ্রমণ সাহিত্যেও রয়েছে বেলের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ‘The Desert and the Sown’ এবং ‘The Letters from Baghdad’-সহ তার অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ লেখাগুলো পাঠকদের কাছে তার ভ্রমণের প্রাণবন্ত বর্ণনা তুলে ধরেছে। তার কাজগুলো শুধু ভ্রমণকাহিনী হিসেবেই নয় বরং গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক রেকর্ড হিসেবেও কাজ করেছে। যা আজও সমান আলোচিত। মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খাওয়ার কারণে ১৯২৬ সালের ১২ জুলাই বাগদাদে গারট্রুড বেলের জীবনের অকাল সমাপ্তি ঘটে।

ফ্রেয়া স্টার্ক
ফ্রেয়া স্টার্ক (৩১ জানুয়ারি ১৮৯৩ - ৯ মে ১৯৯৩) একজন ব্রিটিশ ইটালিয়ান অনুসন্ধানকারী এবং ভ্রমণ লেখক। তিনি মধ্যপ্রাচ্য এবং আফগানিস্তানে তার ভ্রমণ নিয়ে দুই ডজনের বেশি বই লিখেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন আত্মজীবনীমুলক কাজ এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তিনি ছিলেন দক্ষিণ আরবের মরুভূমির মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করার জন্য পরিচিত প্রথম নন-আরবদের একজন।
ফ্রেয়ার বয়স যখন নয় বছর, তার হাতে আসে আরব্য রূপকথার বই ‘One Thousand and one night’। সেই বই পড়েই মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণের অদম্য ইচ্ছা তৈরি হয়েছিল তার। কিন্তু ছোটবেলায় তা আর সম্ভব হয়নি। ইতালি এবং ইংল্যান্ড ঘুরাঘুরির মাধ্যমেই ফ্রেয়া তার শিশুকাল অতিবাহিত করেন। ১৯১২ সালে বেডফোর্ড কলেজে পড়াশোনার জন্য তিনি লন্ডনে আসেন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধ শেষ হলে তিনি ইতালি চলে আসেন এবং আরবি পড়া শুরু করেন। অবশেষে ১৯২৭ সালে মধ্যপ্রাচ্য পরিভ্রমণের জন্য তিনি বৈরুতের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। তার পরের কিছু বছর তিনি সিরিয়া, ইরান, ইরাক ও ইয়েমেন ভ্রমণে অতিবাহিত করেন। তিনি The Southern Gates of Arabia (1936), Letters from Syria (1942), এবং  Alexander's Path (1958)-সহ আরও অনেক বইয়ে নিজের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখেছেন। স্টার্ক একজন প্রতিভাবান লেখক ছিলেন। তার বইগুলো মধ্যপ্রাচ্য এবং আফগানিস্তান সম্পর্কে পৃথিবীকে একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্টার্ক এডেন বাগদাদ এবং কায়রোতে ব্রিটিশ তথ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য কাজ করতেন। যুদ্ধ শেষ হতেই তিনি আবার ভ্রমণ এবং লেখালেখি শুরু করেন। তিনি এশিয়ার নেপাল এবং আফগানিস্তানও ভ্রমণ করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে ১০০ বছর বয়সে তিনি পরপারে চলে যান।

ইসাবেলা বার্ড
ইসাবেলা বার্ড ছিলেন একজন ইংরেজ ভ্রমণ লেখক, অনুসন্ধানকারী এবং ফটোগ্রাফার। ১৮৩১ সালের ১৫ অক্টোবর ইংল্যান্ডের ইয়োর্কশায়ারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম নারী যিনি ‘রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি’র সদস্য ছিলেন। 
শারীরিক অসুস্থতার ভিতর দিয়েই কেটেছে বার্ডের জীবনের বেশিরভাগ সময়। কিন্তু অসুস্থতা তাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। ১৮৫৪ সালে বার্ড প্রথম আমেরিকা ভ্রমণ করেন এবং এরপর একে একে জাপান, কোরিয়া, চীন, ভারত এবং মধ্যপ্রাচ্য। ১৮৯০ সাল নাগাদ তিনি মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। সেই যাত্রায় তিনি পারস্য, কুর্দিস্তান এবং তুরস্ক সফর করেছিলেন। তিনিই প্রথম নারী পরিব্রাজক যিনি একা একা এই দেশগুলিতে ভ্রমণ করেছিলেন এবং নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন। 

মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রমণ বার্ডের জীবনের একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা তিনি ‘জার্নিস ইন পারসিয়া অ্যান্ড কুর্দিস্তান’ বইয়ে লিখেছেন। এই বইটি একটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল, যা ১৯ শতকের শেষের দিকের আরব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করে।

এছাড়াও তিনি তার বৈচিত্র্যময় ভ্রমণ অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন ‘The English woman in America’, ‘Unbeaten Tracks in Japan’ এবং ‘The Yangtze Valley and Beyond’ ইত্যাদি বইসমূহে। তার বইগুলো পৃথিবী সম্পর্কে পাঠকদের গতানুগতিক চিন্তাধারাকে বদলে দিয়েছে। তাকে বলা হয় নারী ভ্রমণকারীদের অগ্রদূত। ১৯০৪ সালের ৭ অক্টোবর শারীরিক অসুস্থজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন বার্ড। নারীরাও যে পুরুষদের ন্যায় দুঃসাহসিক হতে পারে তা তিনি কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। তার কর্মময় জীবন বহু নারীর অনুপ্রেরণা এবং পথপ্রদর্শক।