প্রাণীরা কি অন্য প্রজাতির ভাষা বুঝতে বা শিখতে পারে?

ফিচার ডেস্ক
  ০৬ মার্চ ২০২৫, ২২:৩০

প্রাণীরা প্রতিদিন তাদের চারপাশে অন্যান্য প্রজাতির 'ভাষা' শুনতে পায়। তারা কি বুঝতে পারে, অন্যরা কী বলছে? এমন প্রশ্ন উঠে আসা স্বাভাবিক।
প্রাণীরা কীভাবে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে, ক্রমাগত আমরা সে সম্পর্কে নতুন তথ্য জানতে পারছি। গবেষণায় দেখা গেছে, হাতিরা কান নাড়িয়ে এবং গর্জন করে একে অপরকে অভ্যর্থনা জানায়। তিমিরা নিজেদের মধ্যে 'কথোপকথন' করে; কেবল শব্দই নয়, তাদের জটিল স্বর পানির নিচে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে পারে আরেক তিমির কাছে। এমনকি ক্ষুদ্র প্রাণী ইঁদুরেরও দলগুলোরও নিজস্ব 'উচ্চারণ' রয়েছে।
এটা স্পষ্ট যে প্রাণীজগতে যোগাযোগ জটিল। কিন্তু যোগাযোগের অনন্য উপায়ের সঙ্গে, একটি প্রাণীর পক্ষে কি অন্য প্রজাতির 'ভাষা' শেখা সম্ভব?
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এমন কিছু উদাহরণ রয়েছে যেখানে প্রাণীরা তাদের নিজস্ব প্রজাতির বাইরে অন্য প্রজাতির কণ্ঠস্বর বা সংকেত বুঝতে শিখছে - এমনকি ব্যবহারও করছে। কিন্তু সেই প্রাণীদের মাথায় কী চলছে, তা নিয়ে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
প্রথমত, এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, 'ভাষা' একটি কার্যকর রূপক বিষয়। প্রাণীদের আসলে মানুষের মতো ভাষা নেই। জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাইমন ডব্লিউ টাউনসেন্ড লাইভ সায়েন্সকে বলেন, ভাষা হলো মানুষের সাথে এক ধরণের প্রজাতি-নির্দিষ্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রাণীদের অধ্যয়ন করার সময় বিজ্ঞানীরা 'ভাষা'-এর মতো মানব-কেন্দ্রিক শব্দ ব্যবহার না করে যোগাযোগের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো পরীক্ষা করেন। যেমন: একটি নির্দিষ্ট 'শব্দ' কিংবা 'অঙ্গভঙ্গি', যার নির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে।
অন্যান্য প্রজাতির 'শব্দ' বোঝার ক্ষেত্রে এ যাবতকালে পাখিদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি অধ্যয়ন করা হয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একাকী পাখিরা চলার পথে অন্যান্য প্রজাতির পাখির ডাক বুঝতে পারে। এগুলো সম্ভবত তাদের নিরাপদ থাকতে এবং দীর্ঘযাত্রা মসৃণ করতে সহায়তা করে।
গবেষণার প্রথম লেখক এবং ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক বেঞ্জামিন ভ্যান ডোরেন লাইভ সায়েন্সকে বলেন, প্রজাতির মধ্যে সামাজিক সংযোগ আছে কি না তা নিয়ে ভাবা যুক্তিসঙ্গত।
আফ্রিকাজুড়ে পাওয়া একটি ছোট একটি পাখি কাঁটা-লেজযুক্ত ড্রঙ্গো বা কালো ফিঙে। এদের অভ্যাস আছে, অন্য প্রাণীদের পিছু তাড়া করে তাদের খাবার চুরি করা।
কানাডার ক্যাপিলানো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান প্রশিক্ষক থমাস ফ্লাওয়ার মাঠে এই পাখিদের উপর গবেষণা করেছেন। তারা 'মিরক্যাট' নামের এক ধরণের বেজীর দলকে অনুসরণ করছিল। তিনি দেখেছেন, ড্রঙ্গোরা অন্য প্রাণীদের পেছনে তাড়া করার সময় নিজস্ব 'সংকেত' ব্যবহার করে। তারা একভাবে গাঁ ঝাঁকুনি দেয়, যার অর্থ শিকারী এগিয়ে আসছে। আর এতে ভয় পেয়ে মিরক্যাটরা গর্তে লুকায়।
কিন্তু এই কৌশলটি মাঝে মাঝে মিরক্যাটরা বুঝতে পারে। যখন তারা অনুধাবন করে ড্রঙ্গোর 'অ্যালার্ম'গুলো একটি কৌশল, তখন তারা লুকিয়ে থাকা বন্ধ করে দেয়।
আর এখান থেকেই ড্রঙ্গোদের বিশেষ প্রতিভার শুরু। কাঁটা-লেজযুক্ত ড্রঙ্গোরা কেবল তাদের আশেপাশের অন্যান্য প্রাণীদের সতর্কীকরণ ডাকই চিনতে পারে না, বরং তারা তাদের সুবিধার জন্য অন্যদের ডাকগুলো প্রতিলিপি করতেও শেখে।
যখন এই পাখিরা বুঝতে পারে যে, তাদের নিজস্ব সংকেত আর কাজ করছে না, তখন তারা অন্যান্য পাখির বিপদ সংকেত অনুকরণ করতে শুরু করে - এমনকি মিরক্যাটদের নিজস্ব বিপদ সংকেতও তৈরি করে। নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রজাতির বিপদ সংকেত প্রয়োজন মতো অদলবদল করে এরা।
থমাস ফ্লাওয়ার বলেন, ড্রঙ্গোরা যে প্রজাতির অনুসরণ করে, তাদেরই অনুকরণ করতে জানে। এটি করে তারা 'খাবার প্রতারণার চক্র' চালিয়ে যেতে পারে। এরা অন্যান্য পাখিদেরও অনুসরণ করে এবং তাদের কাছ থেকে খাবার চুরির জন্য প্রয়োজন মতো শব্দ বা ইঙ্গিত অনুকরণ করে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, এই কৌশলটি দেখায় যে, ড্রঙ্গোরা নমনীয়ভাবে অন্য প্রজাতির 'ভাষা' বা 'শব্দ' শিখতে এবং তাদের সুবিধার্থে এটি ব্যবহার করতে সক্ষম। একটি শব্দ যখন কাজ করা বন্ধ করে দেয়, তখন তারা নতুন শব্দের দিকে ঝুঁকতে জানে।
জীববিজ্ঞান প্রশিক্ষক থমাস ফ্লাওয়ার আরও বলেন, যখন ড্রঙ্গো মিথ্যা শব্দগুলো উচ্চারণ করে, তাদের মনে ঠিক কী চলে তা দেখার চেষ্টা চলছে। ড্রঙ্গোরা কি অন্য প্রাণীদের সাথে প্রতারণা করতে চায় - যার অর্থ আরও জটিল জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া। নাকি তারা এইমাত্র শিখেছে যে, নির্দিষ্ট শব্দ পুনরাবৃত্তি করলে খাবার তৈরি হয়।
ফ্লাওয়ার বলেন, ছোট মানুষরাও এমন শব্দ পুনরাবৃত্তি করে, যা তারা বোঝে না। তবে অবশেষে চেষ্টা এবং ত্রুটির মাধ্যমে শব্দের অর্থ শেখে। আপাতত ড্রঙ্গোদের মধ্যে 'ভাষা' শেখার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তবে অনেক কিছুই রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে।