আবারও ফিরে এসেছে সেই উত্তাল মার্চ। পেরিয়ে গেছে ৫৪ বছর। বাংলাদেশের জন্ম ও এ দেশের মানুষের আত্মত্যাগের এক অবিস্মরণীয় মাস। আমাদের স্বাধীনতার মাস।
"কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী, পূরুষের তরবারী;
প্রেরনা দিয়েছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়ালক্ষী নারী ”-
কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ পঙ্ক্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আরও বেশি সত্যি হয়ে উঠেছিল। একাত্তরে নারীদের অবদান তাই অবিস্মরণীয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো এদেশের মানুষের জীবন মরণের যুদ্ধ , একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধ , অস্তিত্বের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছিলেন অস্তিত্বের প্রয়োজনে। শুধু প্রেরণা আর উৎসাহ নয় , সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে নারীরা।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নারীরাও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। নারী তার সব সামর্থ্য প্রয়োগ করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরিতে। তারা মুক্তিযুদ্ধে অত্যাধুনিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ থেকে শুরু করে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।
১৯৭১ সালে সিলেট অঞ্চলের নারীরাও পিছিয়ে ছিলেননা, যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বিভিন্নভাবে। তাদের এই অংশগ্রহণ মুক্তিযুদ্ধকে করেছিল বেগবান।
নারীদের কেউ অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শত্রুর ওপর, আবার কেউ কেউ পালন করেছিলেন সেদিন সংগঠকের ভূমিকা। পাক হায়েনাদের লালসার শিকার হয়েছেন সিলেটের জকিগঞ্জের এশনু বেগমসহ অসংখ্য নারী। সেই সঙ্গে শত্রুর হাতে ঝরেছে তাদের প্রাণ। কিশোরী, তরুণী, যুবতী, বৃদ্ধা কেউই রেহাই পাননি বর্বরদের হাত থেকে।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো সিলেটের নারীরাও রাজপথে ছিলেন সক্রিয়। মুক্তিকামী সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করতে অনুপ্রেরণা যোগাতে মিছিলের অগ্রভাগে থেকে তারা স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত করেছিলেন রাজপথ। উত্তাল মার্চে সিলেটে যে ক’টি মিছিল সমাবেশ হয়েছিল তার প্রতিটিতেই নারীদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো।
নারীরা শুধু পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশগ্রহণই করেননি নিজেরাও নানা কর্মসূচি পালন করেন পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার আন্দোলনে। অগ্নিগর্ভ মার্চে মিছিল সভা সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবকিছুতেই নারীর অংশগ্রহণ স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।
সিলেটে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত যে সব নারী অক্লান্ত পরিশ্রম করে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে কাঁকন বিবি বীরপ্রতীক, জোবায়দা খাতুন চৌধুরী, সিরাজুন্নেছা চৌধুরী, সুহাসিনী দাশ, প্রীতিরানী দাশ পুরকায়স্ত, হেনা দাশ, ঊষা দাশ পুরকায়স্ত, ষোড়শী চক্রবর্তী, আলম রওশন চৌধুরী, দীপালি চক্রবর্তী, ফাহমিদা রশীদ চৌধুরী, খোদেজা কিবরিয়া, আবেদা চৌধুরী, সৈয়দা জেবুন্নেছা হক, ফাতেমা চৌধুরী, জাহানারা আফসার, রায়হানা শফি, নিবেদিতা দাশ পুরকায়স্ত, রত্না চক্রবর্তী, নিবেদিতা দাশ, রাখি দাশ পুরকায়স্তের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও মুক্তিসেনাদের চিকিৎসা সেবা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার তৈরি ও সরবরাহ, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য তরুণদের উৎসাহিত করা, তাদের প্রশিক্ষণে পাঠানো, শরণার্থী নারী ও শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর কাজ করেছেন এই নারীরা।
তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল হক, আওয়ামী লীগ নেতা হেমেন্দ্র দাশ পুরকায়স্থ, ধর্মগুরু প্রভাত চন্দ্র চক্রবর্তী, খাসিয়া নেতা ও চেলা মুক্তিফৌজ সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক দেবদাস রায়সহ কয়েকজনের সহায়তায় সিলেটের নারীদের নিয়ে মহিলা মুক্তিফৌজ গঠন করা হয়।
১৯৭১ সালের ৫ জুলাই ৫ নম্বর সেক্টরের চেলা সাব-সেক্টর সদর দপ্তর মুক্তাঞ্চলের হক নগর (বাশঁতলা) এলাকায় বাংলাদেশ মহিলা মুক্তিফৌজ সংগ্রাম পরিষদ গঠনের লক্ষ্যে সভা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রীতি রানী দাশ পুরকায়স্থকে সভানেত্রী, গীতা রানী নাথকে সহ-সভানেত্রী ও নিবেদিতা দাশকে সম্পাদিকা করে এই কমিটি গঠন করা হয়। সদস্য করা হয় সুধা রানী কর, প্রমীলা দাস, যুথিকা রানী রায়, শক্তি দেবী কাঁনন, মঞ্জু রানী দেবী, সুষমা দাস, সুনীতি দেবী, শেফালী দাস ও রমা রাণী দাসকে।
সংগঠনে অন্তত ২৫ জন নারী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সমাজসেবী অঞ্জলি লাহিড়ী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক কাজ করেন। তার পৈত্রিক ভিটে ছিল সিলেটে। মহিলা মুক্তিফৌজ সংগ্রাম পরিষদ তারও ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী এবং প্রবাসী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান মহিলা মুক্তিফৌজের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। তারা অর্থ সহায়তাও করেন। চেলা ক্যাম্পে এই সংগঠনের ৩০ জন নারী ছিলেন যারা নার্সের প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ফার্স্ট এইড দিতেন।
১৯৭১ এর আগস্ট মাসে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বিপুল প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। পাকিস্তানীদের বহর গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়। সিদ্ধান্ত হয় একটি ব্রিজ ধ্বংসের। কারণ ওই ব্রিজ ধরেই মিলিটারিরা আসে। পাকিস্তানীদের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয় কাঁকন বিবি। কলাগাছের ভেলায় করে গোলাবারুদ বহন করে ব্রিজের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পৌঁছে দেন কাঁকন বিবি। ওই বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করা হয় জার্ডিয়া ব্রিজ। এই অপারেশন হয়েছিল গভীর রাতে। একাই মাইন, অস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে কলাগাছের ভেলায় চেপে ব্রিজের কাছে গিয়েছিলেন কাঁকন বিবি। কেবল জার্ডিয়া ব্রিজই নয় সুনামগঞ্জে দুঃসাহসী সব যুদ্ধে পরোক্ষভাবে তথ্য দিয়ে শামিল ছিলেন কাঁকন। বসরাই টেংরা টিলা যুদ্ধ, বেটিরগাঁও নুরপুরের যুদ্ধ, টেবলাইয়ের যুদ্ধ, মহব্বতপুরের যুদ্ধ, সিলাইরপাড়ের যুদ্ধ সহ গোটা বিশেক যুদ্ধে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে অংশ নেন কাঁকন। মুক্তিবাহিনীর ২০টির বেশি সম্মুখযুদ্ধে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তার কারণেই মুক্তিবাহিনী হানাদারদের নির্ভুল তথ্য পেয়েছিল। বিনা ঝুঁকিতে অস্ত্র গোলাবারুদের সরবরাহ পেয়েছিল। এমনকি পাকিস্তানিদের গোলাবারুদ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। কিন্তু টেংরা টিলা যুদ্ধে উরুতে গুলিবিদ্ধ হন কাঁকন। কেবল টেংরা টিলাই নয় বাংলাবাজার, দুরবিন টিলা, আঁধার টিলা সহ মোট নয়টি যুদ্ধে সরাসরি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করেছিলেন কাঁকন। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে আমবাড়ি যুদ্ধে ফের গুলিবিদ্ধ হন কাঁকন।
কাঁকন বিবি (মৃত্যু: ২১ মার্চ, ২০১৮) ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীরযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও গুপ্তচর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে মুক্তিবাহিনীর হয়ে ৫ নং সেক্টরের গুপ্তচরের কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। কাঁকন বিবি মুক্তিযুদ্ধ জয়ী আটপৌড়ে এক গ্রাম্য পাহাড়ি খাসিয়া নারী। নিভৃত জীবনযাপন শেষে মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালে তিনি অন্ধকার ভেদ করে প্রচারণায় আলোয় আসেন। আদিবাসী গ্রাম্য এই নারী সরাসরি অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে জীবনবাজি রেখে বীরোচিত ভূমিকা রেখেছেন স্বাধীনতাযুদ্ধে।
যুদ্ধদিনের এসব নারীদের ভূমিকা ও বীরত্বগাথা কোনো অংশে কম ছিল না। তারা জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করে গেছেন। তাদের স্বীকৃতি অবশ্যই দেওয়া উচিত।
মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের নারীদের অনন্য ভূমিকা ছিল। অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে নার্সের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের সর্ম্পকে নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে।
নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আজো আমরা পিছিয়ে । আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকার সঠিক মূল্যায়ন করা সময়ের দাবি ।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি আজও। এর একটি কারণ হতে পারে অতিসাধারণ আপামর নারীদের ব্যাপকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ। পুরুষের পাশাপাশি সেদিনের নারীর বুদ্ধি-বিচক্ষণতা, আন্তরিকতা ও সাহসের ফল এই স্বাধীনতা। নারী মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পাননি। ইতিহাস থেকে যা জেনেছি, তাতেই ওই সময়ের সাহসী নারীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথা নিচু হয়ে আসে। তাই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের সেই মহীয়সী নারীদের নাম- যাদের জীবনের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র, তাদের অবদান পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে।
বাঙালির ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এ মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাই তাদের এই অবদানকে যথাযথভাবে সম্মান ও স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আজো আমরা পিছিয়ে । আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকার সঠিক মূল্যায়ন করা সময়ের দাবি ।