‘তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে’। এই তিন পাগল কারা? লালন গানের মধ্যেই জবাব দিচ্ছেন ‘ও সে চৈতে নিতে অদ্বে পাগল নাম ধরেছে’। লালন গবেষকগণের আলোচনায় আমরা জানতে পারি, ‘চৈতে’ মানে শ্রীচৈতন্য, আর ‘নিতে’ ও ‘অদ্বে’ শ্রীচৈতন্যের দুই প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দ ও অদ্বৈতাচার্য।
আমরা জানি, শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাব এবং তাঁর প্রেমধর্মে ভেসেছিল সেই সময়ের নদীয়া-কুষ্টিয়া অঞ্চল। লালন তাঁর গানের বাণীতে সে কথাই তুলে এনেছেন। যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলে লালন, মাইকেল মধুসূধন দত্ত, মীর মশাররফ হোসেন, কাঙাল হরিনাথ, গগণ হরকরা, সুলতান, বিজয় সরকার, নৃত্যশিল্পী
উদয় শঙ্করসহ আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি জন্মেছেন। বিশ্বকবির শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির সূতিগাকারও ছিল এই অঞ্চল। কুষ্টিয়া-নদীয়া অঞ্চলেই বাঙলার ভাব আন্দোলনের সৃষ্টি। এই অঞ্চলের অনেক প্রতিভাধর ব্যক্তি দ্বারা বাঙলা ভাষা, সাহিত্য ও সমাজ চিন্তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রথমবারের মতো সৃষ্টি হয়েছিল। বাঙলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিপুল সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েছে এই অঞ্চলের অনেক সৃষ্টিশীল মানুষের প্রতিভার চূড়ান্ত বিকাশের মধ্য দিয়ে। তাই দুই বাঙলার ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ হতে পারে যশোর-কুষ্টিয়া-নদীয়া অঞ্চল।
লালন উৎসবে কুষ্টিয়ার কথা আসলে যে দু’জন বিখ্যাত মানুষের নাম সবার আগে আসবে তাঁদের মধ্যে একজন বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই দুজন মনীষীর বহু স্মৃতিবিজড়িত এবং সৃষ্টিকর্মের ক্ষেত্র কুষ্টিয়া। প্রখ্যাত সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন ও বাঙলার প্রথম সংবাদপত্রের প্রবর্তক হিসাবে বিখ্যাত কাঙ্গাল হরিনাথের নামও চলে আসবে কুষ্টিয়ার কথা লিখতে গিয়ে। আমরা এই বিখ্যাত মানুষগুলোর জীবন ও কর্মের টানে প্রথমবারের মতো কুষ্টিয়া ভ্রমণে আসি। অবশ্য লালন মেলাও তখন একটি উপলক্ষ্য তৈরি করেছিল আমাদের এই ভ্রমণে। আমরা মানে চারজন ভ্রমণসঙ্গী আবু ইউসুফ, বাকিউল, টিটু এবং আমি।
ঢাকা থেকে সকালে রওয়ানা দিয়ে বিকালে পৌঁছে যাই শহরে। বাস থেকে নেমেই লক্ষ্য করি, কুষ্টিয়া শহরের মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য। ভাস্কর্যগুলো ছোট্ট এই শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। প্রতি বছর লালন সাঁইজি’র জন্ম ও মৃত্যু দিবসকে কেন্দ্র করে ১ কার্তিক থেকে লালন মেলা জমে ওঠে। ফাগুন মাসে লালন সাঁইজি কর্তৃক প্রবর্তিত ৩ দিনব্যাপী দোল পূর্ণিমার উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। তখনও কুষ্টিয়া অঞ্চলজুড়ে চলে উৎসবের আমেজ। এই সময় কুষ্টিয়া ভ্রমণের জন্য বেছে নিলে পর্যটকদের জন্য নতুন মাত্রা যুক্ত হতে পারে।
প্রথমেই মাথা গোঁজার ঠাই খুঁজে বের করি। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওয়ানা হয়ে যাই ছেঁউড়িয়ার উদ্দেশ্যে ফকির লালন সাঁইয়ের আখড়ায়। কুষ্টিয়া শহর থেকে প্রায় ৮ কি.মি. দূরে ছেউড়িয়া গ্রামে লালনের সমাধি ও আখড়া অবস্থিত। লালন আখড়ায় যেতে পড়ে কালীগঙ্গা নদী। কালীগঙ্গার বুক চিরে রাস্তা চলে গেছে। নদী অনেক আগেই মৃত। কার্তিকের এই উৎসবই সবচাইতে বড়। একই সাথে বসে বিশাল মেলা। দেশ বিদেশের বাউল ও ভক্তগণ এখানে এসে জড়ো হন এই সময়ে। লালনের গানের অমর বাণী ও সুরে লালন আখড়া এই সময়ে সবচাইতে বেশি জমজমাট থাকে।
ফকির লালন-এর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে মতান্তর রয়েছে। তার জাতি ধর্ম বিষয়েও সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় না। কথিত আছে তাঁর জন্ম হিন্দু কায়স্থ পরিবারে। কোনো এক সময় তিনি এক বাউল দলের সঙ্গী হয়ে গঙ্গা স্নানে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গীরা তাঁকে নদীর তীরে ফেলে যান। সিরাজ সাঁই নামক এক মুসলমান বাউল তাকে সেবা-শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তোলেন। এরপর লালন সিরাজ সাঁইর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে মরমী সঙ্গীত সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। সিরাজ সাঁইর মৃত্যু হলে তিনি কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় আখড়া স্থাপন করে সেখানে তাঁর সঙ্গীত সাধনা শুরু করেন। নিজ সাধনায় তিনি হিন্দু-মুসলমান শাস্ত্র সর্ম্পকে বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন।
একইসঙ্গে বাউল সঙ্গীতে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন। তাঁর গান আধ্যাত্মিক, মরমী, জীবন জিজ্ঞাসায় প্রশ্নাকুল ও শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা সহস্রাধিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বপ্রথম লালনের ২৯৮টি গান সংগ্রহ করে ২০টি গান তৎকালীন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখী’, ‘বাড়ির পাশে আরশি নগর’, ‘মিলন হবে কত দিনে আমার মনের মানুষের সনে’, ‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে’ ইত্যাদি অসংখ্য গানের ‘বাউলতত্ত্ব’ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক ছেঁউড়িয়ায় ফকির লালন দেহত্যাগ করেন।
বিশাল মাঠজুড়ে জায়গায় জায়গায় আখড়া তৈরি করে গান হচ্ছে। বসেছে মেলার পশরা। মাঠে ঢোকার সাথে সাথে গঞ্জিকার ধোঁয়ার তীব্রতা নাকে ধাক্কা মারে। আমরা তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর এলেবেলে আর খাপছাড়া ভাষণ ও উদ্বোধন ঘোষণা শোনার ‘দুর্লভ’ সৌভাগ্য অর্জন করি। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, ‘কুষ্টিয়া জাতি’র গর্ব ফকির লালন সাঁইজি আমাদের অহঙ্কার। কথাটি দুইবার বলেন মন্ত্রী। শুনে আমরা হাসতে হাসতে একে অন্যের উপর গড়িয়ে পড়ার যোগাড়! আমাদের এক বন্ধু বলে, ‘চারদিকের ধোঁয়া নিশ্চয়ই মন্ত্রীর মাথা এলোমেলো করে দিয়েছে!’
মধ্যরাত অবধি ছিলাম ছেঁউড়িয়ার লালন মেলায়। এর মধ্যে বন্ধু টিটু লালন উৎসবের একজন স্থানীয় গাইডের সন্ধান করতে গিয়ে ঢাকার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের এক চরম আড্ডাবাজ লেখক পান্ডাকে আবিষ্কার করে ফেলে। দেখতে হালকা-পতলা ও লম্বা এবং কথাবার্তায় ভীষণ স্মার্ট। আমরা পড়ে যাই মোঘলের পাল্লায়। সে নিজেই বলে, আমি যখন ঘর থেকে বের হই আর ঘরে ঢুকি না, আবার ঘরে ঢুকলে আর বের হই না! অদ্ভূত ভাবরসের কথা! খানাপিনার সাথে সাথে সে আমাদের এমনই গাইড করা শুরু করে যেনো গোটা লালন আখড়ার নাড়ীনক্ষত্র সে দেখিয়েই ছাড়বে! সমস্ত কুষ্টিয়া শহরের লোকজন তার পরিচিত। তার সাথে যারই দেখা হচ্ছে তাদেরকে আমাদের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এই আখড়া, ওই আখড়া করতে করতে এক সময় সে ফরহাদ মজহারের আখড়াতেও ঢুঁ মারে। ঘুরতে ঘুরতে আমাদের ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে একসময় আমরা রণে ভঙ্গ দেই। বলা যায় পালিয়ে বাঁচি।
হঠাৎ করেই টিটু আবিষ্কার করে মেলার এক উন্মুক্ত স্থানে কীসের নেশায় যেনো বুঁদ হয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে গান শুনছেন আমাদের তখনকার মধুর কেন্টিনের আড্ডাবাজ সিনিয়র এক দাদা। টিটু বেশ উৎসাহের সাথে কথা বলতে গেলে গভীর ধ্যানরত দাদা বিরক্ত হয়ে মাথা তুলে টিটুকে দেখেন এবং ‘জিনের বাদশা’র মতো কণ্ঠ করে বলেন, ‘টিটু, তোমার কাজ তুমি করো। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’ আমরা তৎক্ষণাৎ বড়ো ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলি, ‘জয়গুরু!’ টিটুর উদ্দেশ্যে বলি, ‘এরপর?’
সেদিন আমাদের বন্ধুকে কীসে পেয়েছিল জানি না! এবার সে মাঠের মধ্যে একজন জটাধারী, গেরুয়া রঙের বস্ত্রপরিহিত সাধুকে খুঁজে বের করে। তিনিও একটা আখড়া সামলাচ্ছেন। সাধু আমাদের সমাদর করে বসান। আপ্যায়ন করান। জিলিপি কিনে খাওয়ান এবং গান শোনান। টিটু পরমানন্দে আটখানা। পারলে এখুনি তিন পাগলের একপাগল হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দেয়! গভীর রাতে হেঁটে হেঁটে হোটেলে ফিরি। ফেরার পথে শহরের একটি মোড়ে বিজয় সরকারের গান আমাদের ভীষণ মুগ্ধ করে। ‘সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে।’ গানটির সাথে সাথে আমরা আবেগ বিহ্বল হই। পরদিন ছিল শহরের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে বেড়ানোর আয়োজন।
কুষ্টিয়ায় প্রথম সকাল। আমরা একটি ভ্যান নিয়ে কুষ্টিয়ার দর্শনীয় স্থান দেখতে বেরিয়ে পড়ি। কুষ্টিয়ায় অবস্থিত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত দুটি স্থান হচ্ছে টেগর লজ ও শিলাইদহ কুঠিবাড়ী। শহরের স্টেশন রোডে মিলপাড়াতে অবস্থিত টেগর লজ। টেগরলজ এখন ভগ্ন দশায় পতিত। কথিত আছে রবীন্দ্রনাথ এ বাড়ি থেকে পাটের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। পরে তাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারী যজ্ঞেশ্বরকে এই বাড়ি দান করে দেন। কুষ্টিয়া শহর থেকে ২০ কি.মি. দূরে অবস্থিত শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। এটি বিশ্বকবির অন্যতম স্মৃতিবিজড়িত স্থান। রবীন্দ্রনাথ জমিদারী পরিচালনার জন্য প্রায়ই শিলাইদহে আসতেন। এখানে বসে তিনি বহু কবিতা ও অন্যান্য সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন। কুঠিবাড়ীতে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত বেশ কিছু জিনিসপত্র ও বই সংরক্ষিত আছে। গাছগাছালি ঘেরা, চমৎকার পুকুর- সব মিলিয়ে কুঠিবাড়ির পরিবেশটা আমাদের ভীষণ ভাল লাগে। খানিকটা দূরেই পদ্মা। রবিঠাকুরের প্রিয় পদ্মা। আমরা যখন কুঠিবাড়ি গিয়েছিলাম তখন রেড অক্সাইডের আদি রঙ টিকেছিল। পরবর্তীতে কুঠিবাড়িকে সাদা রঙ করা হয়েছিল। লাল রঙটি সেই সময়ের একটি আবহ তৈরি করেছিল। এখানকার আমলাদের বুদ্ধি ও বিবেচনা যে কত অগভীর তার প্রমাণ এগুলো। শুধু শিলাইদহ নয়, সারাদেশে আরো বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও প্রত্মতাত্ত্বিক স্থাপনা ইচ্ছেমতো কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছে, রঙ পরিবর্তন করা হয়েছে, এমনকি মূল নকশাঁও পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে! সমালোচনার মুখে অবশ্য কুঠিবাড়ী আবার তার পুরনো রেড অক্সাইডে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
পদ্মার এপারে কুষ্টিয়া ওপারে পাবনা। কুষ্টিয়া গেলে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখে আসা যায়। বিখ্যাত কাপড়কল মোহিনী মিলসের নাম এখন শাহ মখদুম মিলস। মোহিনী মিলসের কাপড় আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানী হতো। একসময় এটি বিটিএমসির মালিকানায় ছিল। এখন ব্যক্তি মালিকানায়। টেগর লজ থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলে পড়বে মোহিনী মিলস। ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মোহিনী মিলস পূর্ববঙ্গের প্রাচীনতম কাপড়ের মিল। এটিও একটি ঐতিহ্য বটে। শহরের কাছাকাছি রয়েছে কুষ্টিয়া টেক্সটাইল মিল এবং জগতি সুগার মিল। কুষ্টিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে কুমারখালীতে রয়েছে বেশ কটি টেক্সটাইল মিল। সব মিলিয়ে কুষ্টিয়ার কাপড়ের ঐতিহ্য এখনো আছে।
শিলাইদহ থেকে ফেরার পথে আমরা মীর মশাররফের বাড়ি, কাঙাল হরিনাথের ভিটা ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন ছাপাখানা ঘুরে দেখি। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার কুমারখালীর কুন্ডুপাড়া গ্রামে জন্ম। তিনি সমাজবিপ্লবী, সম্পাদক এবং সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত। কাঙাল হরিনাথ বাউল ‘ফিকির চাঁদ’ নামেও সুপরিচিত ছিলেন সেই সময়। তিনি ছিলেন গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবর্তক। তাঁর সম্পাদিত গ্রামবার্তা প্রকাশিকা (১৮৬৩-৮৫) সমকালে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ব্রহ্মান্ড দেব, ফিকির চাঁদের গীতাবলী, বিজয় বসন্ত উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এম এন প্রেসে (মথুরানাথ নামে তার এক প্রিয় বন্ধুর স্মৃতি রক্ষার্থে এই নামটি দিয়েছিলেন) মীর মশাররফ হোসেনের বিখ্যাত ‘বিষাদসিন্ধু’ গ্রন্থটি ছাপানো হয়। ‘গ্রামবার্তা’ পত্রিকাটিও এখান থেকেই প্রকাশিত হত। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখি কাঙাল হরিনাথের স্মৃতিধন্য প্রেস। ছুঁয়ে দেখি কাঙাল হরিনাথের স্পর্শ করা ও স্বপ্নমাখা প্রিন্টিং মেশিনটি। শিহরিত হই এখান থেকেই নানা চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ২২ বছর ব্যাপী একটি উজ্জ্বল
আলোকবির্তকা জ্বালিয়ে রেখেছিলেন একজন মহান ব্যক্তি। কাঙাল হরিনাথের সাথে লালন সাঁইজির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। দীর্ঘদিন অযত্ন ও অবহেলার শিকার কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের পড়ে থাকা ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণে অবশেষে স্মৃতি জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে।
মীর মশাররফ হোসেন ১৮৪৭ সালে কুমারখালীর লাহিনী পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন জমিদার মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাতা ছিলেন দৌলতন নেছা। বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন যার নাম ছিল ‘আজিজুননেহার’ (১৮৭৪-৭৬)। অবশ্য তাঁর বিখ্যাত পত্রিকা ‘হিতকরী’। তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে বিষাদসিন্ধু, জমিদার দর্পণ, উদাসীন পথিকের মনের কথা, গাজী মিয়ার বস্তানী, বসন্ত কুমারী, গোজীবন, আমার জীবনী, সংগীত লহরী ইত্যাদি। তার স্মৃতিধন্য বসতভিটায় তোরণ, কিছু ফলক, বিদ্যালয় ও লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে...’ কুষ্টিয়ার আরেক স্বভাব কবি ও বাউল গগণ হরকরার কথা আমরা অনেকেই জানি। গগণ হরকরাকে আমাদের বিশেষভাবে স্মরণ করতে হবে এই কারণে যে, তাঁর এই গানের সুর নিয়েই রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছেন ‘আমার সোনার বাঙলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটির সুর। যে গানকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেয়া হয়। সামান্য একজন ডাক কর্মচারী (পিওন) ছিলেন গগণ হরকরা। তাঁর এমন আরো অসাধারণ গান রয়েছে। দুঃখের বিষয়, গগণ হরকরার ভিটেমাটিতে এখন ধানচাষ করা হয়। সংরক্ষণ করা হয়নি এই গুরুত্বপূর্ণ মানুষটির স্মৃতিচিহ্ন!
রাতে হোটেলে বসে যথারীতি চলে নানা বিষয়ে আড্ডা। আমাদের আড্ডার আলোচনায় আমরা স্মরণ করি ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবী নেতা যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে, যিনি বাঘা যতীন নামে অধিক পরিচিত। বাঘা যতীনের জন্ম কুষ্টিয়া জেলার ‘কয়া’ গ্রামে। তার পিতার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম শরৎশশী। যতীন শৈশব থেকেই শারীরিক শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কথিত আছে, শুধুমাত্র একটি ছোরা নিয়ে তিনি একাই একটি বাঘকে হত্যা করতে সক্ষম হন বলে লোক মুখে মুখে তাঁর নাম হয়ে যায় ‘বাঘা যতীন’।
কুষ্টিয়ার ইতিহাস পড়তে গিয়ে আরেকজন সাহসী নারীর প্রসঙ্গে জানতে পারি। প্যারী সুন্দরী। বর্তমান মিরপুর উপজেলার সদরপুরের মহিলা জমিদার ছিলেন। তিনি কুষ্টিয়া অঞ্চলের নীল বিদ্রোহের নেত্রী ছিলেন। ১৮৬০ সাল থেকে বাঙলায় যে নীল বিদ্রোহ শুরু হয়, তার প্রথম সূচনা হয় কুষ্টিয়া থেকে। কুষ্টিয়ার শালঘর মধুয়ার কুখ্যাত নীলকর টি. আই কেনির সঙ্গে আমলা সদরপুরের মহিলা জমিদার প্যারী সুন্দরীর লড়াইকে কেন্দ্র করে এই বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে। শালঘর মধুয়ায় ছাউনী করে প্যারী সুন্দরীর নেতৃত্বে কৃষকরা জে. জি মরিসের দলকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। তিনি শালঘর মধুয়ার নীলকুঠি কয়েকবার আক্রমণ করেছিলেন। প্যারী সুন্দরীর নেতৃত্বে এই অঞ্চলের কৃষকদের এই বিদ্রোহের ইতিহাস আজ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে।
প্রসঙ্গক্রমে আসে কুষ্টিয়ার সন্তান রাধা বিনোদ পালের কথা। তিনি ১৮৯৬ সালে দৌলতপুর উপজেলার সেলিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। এছাড়া তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতের প্রধান বিচারক হিসেবে বিচার কার্য পরিচালনা করেছিলেন। অন্যান্য দেশের বিচারকরা যখন জাপানকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করে, তিনি তখন জাপানকে যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে নির্দোষ প্রমাণ করেন। এর ফলে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। জাপানে রাধা বিনোদ পাল অতি সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত। জাপানে কিয়োটো শহরে তাঁর নামে একটি জাদুঘর ও রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।
কুষ্টিয়ায় রয়েছে বেশ কিছু হিন্দু-মুসলিম যুগের নিদর্শন। এসব নিয়ে আমাদের কথা হয় বিস্তর। রাতের আহার সেরে আমরা পদ্মার পাড়ে গিয়ে বসি। অনেকের সাথে রবিঠাকুর, লালন সাঁইজি ও কাঙাল হরিনাথের কথা ঘুরে ফিরে আসে। বিচিত্র আলাপন, ভাবনা এবং নীরবতার মধ্যে আমরা পদ্মার নৈসর্গ উপভোগ করি। আজও অনেক রাতে হোটেলে ফিরি। সকালে আমরা মুজিবনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো।
কুষ্টিয়া ভ্রমণের তৃতীয় দিন ছিল আমাদের মুজিবনগর ভ্রমণপর্ব। রাস্তার অবস্থা খারাপ শুনে ইউসুফ ঘোষণা করলেন, তিনি সারাদিন পদ্মায় ভেসে বেড়াবেন এবং কবিগুরুকে স্মরণ করবেন। অর্থাৎ তিনি মেহেরপুর যাচ্ছেন না। আমরা বলি, ‘তথাস্তু’। আমরা তাঁর সুস্থাস্থ্য কামনা করে একটি লোকাল বাসে চড়ে রওয়ানা হয়ে গেলাম ঐতিহাসিক মুজিবনগরের উদ্দেশ্যে। সব মিলিয়ে দুই ঘণ্টার পথ। মেহেরপুর নেমে দুপুরের আহার সেরে আমরা একটি ভ্যানগাড়ি নিয়ে রওয়ানা হই আমঝুপির উদ্দেশ্যে। এক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাই ঐতিহাসিক আম বাগানে, যেখানে তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল। দেখতে পাই মুজিবনগরে নানা স্থাপনা ও ভাস্কর্য তৈরি করা হচ্ছে। বিশেষ করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভাস্কর্য স্থাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের একটি মোটেলও রয়েছে এখানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকার ও মেহেরপুর খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ফেরার পথে আমরা একটি বিলুপ্তপ্রায় নীলকুঠি দেখে আসি। ব্রিটিশ বেনিয়ারা সেই সময় নীল চাষের মাধ্যমে যে এদেশের কৃষকদের সর্বনাশ করেছিল এটি তারই স্মারক। একই সাথে ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহেরও স্মারক নীলকুঠি। সারাদিন থেকে বিকালে আমরা কুষ্টিয়ার বাসে চড়ি। শহরে পৌঁছাতে রাত হয়। আজ রাতেই আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করব। তাই কিছুটা তাড়াহুড়ো ছিল আমাদের। আহার সেরে চারজন ঢাকার বাসে চড়ে বসি। এরই সাথে সমাপ্ত হয় আমাদের তিন দিনের একটি অনন্য সাধারণ সাংস্কৃতিক পর্যটন।