বছর ঘুরে এলো দুর্গাপূজার প্রহর। পূজার দিনগুলোয় পোশাকের সঙ্গে মিল রেখে সাজগোজ, চুল বাঁধা, গহনা কেমন হবে, তা নিয়ে অনেকের কপালে পড়ে চিন্তার ভাঁজ। এ সময় মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরাঘুরি হয় বেশ। সে ক্ষেত্রে পা গলিয়ে নিতে হবে আরামদায়ক জুতায়। যেহেতু প্রকৃতিতে একই সঙ্গে খানিকটা গরম ও হঠাৎ বৃষ্টির ধাঁচ আছে এ সময় আরামদায়ক সাজ গহনাতেই স্বস্তিতে থাকা যাবে– এমনটাই বলছেন রূপবিশেষজ্ঞরা।
পূজার সাজ মানেই ভারী গহনা, উজ্জ্বল রঙের পোশাকের সঙ্গে বেশ মনোরম মেকআপ। সাজের এমন চল চলেছে বেশ কয়েক বছর। করোনা-পরবর্তী সময়ে গোটা বিশ্বের ফ্যাশন ও রূপসচেতন নারীদের মধ্যে নো মেকআপ লুক ও মিনিমালিস্টিক সাজ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এবারের পূজায় ‘নো মেকআপ লুক’-এ নিজেকে অনন্য করে তুলতে পারেন অথবা ষষ্ঠী থেকে অষ্টমীতে হালকা এবং নবমী-দশমীর দিনে গর্জিয়াসভাবে সাজতে পারেন।
ষষ্ঠীতে টপ-কুর্তা-কামিজের সঙ্গে হালকা সাজ: ষষ্ঠীর বিকেল থেকেই পূজার ঘোরাঘুরি শুরু হয়। এদিনটায় যারা বের হবেন, তাদের সাজসজ্জা হবে একদমই হালকা। মেকআপ আর্টিস্ট রুমানা ইসলাম জানান, ষষ্ঠীতে মুখে ময়েশ্চারাইজার বা সানব্লক মেখে তার ওপর হালকা পাউডারের টাচ কিংবা চাইলে কেউ অল্প করে কমপ্যাক্ট পাউডারও লাগিয়ে নিতে পারেন। এর সঙ্গে চোখে কাজলের রেখা আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়েই ষষ্ঠীর সাজ সেরে ফেলতে পারেন। পোশাকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চুলে করতে পারেন হাত খোঁপা কিংবা ফ্রেঞ্চ বেণি বা পনিটেইল। পোশাকের ক্ষেত্রে বেছে নেওয়া যেতে পারে টপস, কুর্তা, কুর্তি, কাফতান স্টাইলে টিউনিক ও সুতি সালোয়ার-কামিজ। কেউ চাইলে চিকন পাড়ের সুতি শাড়িও পরতে পারেন।
সপ্তমীতে স্নিগ্ধ: সপ্তমীর সাজ হবে ষষ্ঠীর তুলনায় একটু বেশি। সপ্তমীতে অঞ্জলি দিতে যাওয়ার সময় ‘নো মেকআপ লুক’ নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ত্বকে বেস করতে ফাউন্ডেশনের বদলে ব্যবহার করুন বিবি বা সিসি ক্রিম। যদি ফাউন্ডেশন ব্যবহার করতেই চান তাহলে ন্যাচারাল শেডের ফাউন্ডেশন খুবই হালকা করে ব্যবহার করুন। এটি পাউডার দিয়ে সেট করুন। এ লুকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাজল বা আইলাইনার ব্যবহার হয় না। কাজল বা আইলাইনার ব্যবহার করতে চাইলে কাজল লাগিয়ে সেটিকে স্মাজ করে নিতে হবে। সঙ্গে মাশকারা লাগালে চোখ বেশ বড় ও মায়াবী দেখাবে।– জানান রুমানা লাইট ব্রাউন কিংবা হালকা গোল্ডেন টাচ রয়েছে এমন কোনো আইশ্যাডো বেছে নিন। একদম হালকা পিঙ্ক লিপস্টিক বা শুধু লিপ টিন্ট আর গালে হালকা মুস ব্লাশের ব্যবহার আপনার নো মেকআপ লুককে আরও আকর্ষণীয় করে তুলবে।
সপ্তমীতে খোলা চুল থাকুক কিংবা খোঁপা, এর সঙ্গে চুলে ফুলের সাজ কিন্তু নিশ্চিতভাবেই সবার নজর কাড়বে। অষ্টমীতে অনন্য থাকুন: অষ্টমীর সাজটাও সপ্তমীর মতো হতে পারে। হালকা বেসের ওপর হালকা ব্লাশন বুলিয়ে নিন। অল্প হাইলাইটার দিন। হালকা ব্রাউন আইশ্যাডো দিতে পারেন। এদিন চিকন পাড়ের সুতি শাড়ি, সিল্ক কাতান, জামদানি পরতে পারেন। শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে ধ্রুপদি গহনা বেছে নিন। চুল খোঁপা করে তাতে সাদা রঙের কোনো ফুল গুঁজে নিন।
নবমীর দিবানিশিতে: নবমী মানেই বেশ সাজগোজ ও ঘোরাঘুরি। দিনের বেলা ঘোরাঘুরি করলে আরামদায়ক কাপড় পরে বের হোন। সাজও রাখুন হালকা। ব্যাগে ফেস মিস্ট বা রোজ ওয়াটার রাখুন। ঘেমে গেলে ত্বকে স্প্রে করে নিলে মুহূর্তেই সতেজ হয়ে যাবেন। নবমীর রাতে পছন্দের শাড়ি পরুন। শাড়ির রঙের ক্ষেত্রে নীল, সবুজ, কমলা, হলুদ, বেগুনি, যে কোনো উজ্জ্বল রং বেছে নিতে পারেন। সুতি, সিল্ক, কোটা, হাফসিল্ক, তসর ও জামদানি শাড়ি পরতে পারেন। রাজিয়া’স মেকওভারের স্বত্বাধিকারী ও রূপবিশেষজ্ঞ রাজিয়া সুলতানা জানান, নবমীতে শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে কিছুটা ভারী বেস করতে পারেন অথবা হালকা ফাউন্ডেশন বা বিবি-সিসি ক্রিম লাগিয়ে তার ওপর লুজ পাউডার বুলিয়ে নিন। গালে বুলিয়ে নিন ক্রিমি ব্লাসন। চোখে গাঢ় করে কাজল টানুন। আইশ্যাডো হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন ম্যাট ফিনিশের কপার, ব্রোঞ্জ, কোরাল রং। চোখের ইনার সাইডে ভাইব্রেন্ট সিলভার বা গোল্ডেন রঙের আলতো ছোঁয়া রাখুন। এতে চোখ বড় ও আকর্ষণীয় দেখাবে। আইলাইনার হিসেবে কালো, সবুজ, নীল, বাদামি ও বেগুনি রং বেছে নিতে পারেন। ঠোঁটে পিচ, রোজি, অরেঞ্জ, টেরাকোটা, মাউভ বা ন্যুড লিপস্টিক লাগান।
দশমীতে উজ্জ্বল: দশমীতে নিজের ইচ্ছামতো সাজুন। এদিন সাজের ক্ষেত্রে নিয়মের বাইরে যেতেই পারেন। পোশাকের ক্ষেত্রে বেছে নিন গাঢ় রং। রূপবিশেষজ্ঞ রাজিয়া সুলতানা দশমীর সাজে ত্বক অনুযায়ী ময়েশ্চারাইজার ও প্রাইমার লাগানোর পরামর্শ দেন। তিনি জানান, ময়েশ্চারাইজার ও প্রাইমার লাগানোর পর ফুল কাভারেজ ম্যাটিফাইয়িং ফাউন্ডেশন ব্যবহার করুন। তার ওপর প্রেসড পাউডার লাগিয়ে বেইজ সেট করে নিন। পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে একই কালারের শ্যাডো ব্যবহার না করে আইশ্যাডোর ক্ষেত্রে কন্ট্রাস্ট কালার বেছে নিন। চোখের মেকআপে একসঙ্গে কয়েকটা রং ব্যবহার করলে চোখের দীপ্তি বহুগুণে ফুটে ওঠে। তারপর নাক, জলাইন, চিবুকের অংশ কন্ট্যুরিং করে নিন। নাকের আগায়, কপালের মধ্যখানে আর ঠোঁটের নিচে হাইলাইটার লাগিয়ে দিন।
চোখে ভারী মেকআপ নিলে ঠোঁটে লাগান হালকা গোলাপি, ন্যুড, পিচ, বারগেন্ডি ও বেরিস কালারের লিপস্টিক। রাতের সাজের জন্য গ্লসি লিপস্টিক বেছে নিন। গর্জিয়াস স্টাইলের সাজের সঙ্গে চুলের ধরন হতে পারে টুইস্ট, স্পাইরাল, মেসি অথবা ডোনাট খোঁপা। মুখের শেপের সঙ্গে মিলিয়ে সামনের দিকের চুল সেট করুন। সামনের চুল টুইস্ট করে ব্লোড্রাই কার্ল করে নিতে পারেন।
রাবীন্দ্রিক সাজে: পূজার দিনগুলোয় নিজেকে অপরূপা ও অনন্য করে তুলতে রাবীন্দ্রিক স্টাইলে সাজতে পারেন। হয়ে উঠতে পারেন মানসপটে গেঁথে থাকা রবীন্দ্রনাথের বৌঠান কাদম্বরী দেবী, নৌকাডুবি উপন্যাসের হেমনলিনী, নষ্টনীড় উপন্যাসের চারুলতা। ষষ্ঠী থেকে নবমীর দিনগুলোয় পরে নিতে পারেন হালকা রঙের শাড়ি, ডিজাইনবিহীন বা ডিজাইনসহ ফুল হাতা কিংবা থ্রি কোয়ার্টার হাতার ব্লাউজ। হালকা ও গাঢ় রঙের মিশেলে সুতি, তসর, জামদানি বা সিল্কের শাড়ি বেছে নিতে পারেন। দশমীর দিন সাদা-লাল জামদানি, উজ্জ্বল রঙের টাঙ্গাইল কিংবা সিল্ক শাড়ি পরতে পারেন। শাড়ির সঙ্গে খোঁপা অথবা বেণি করে তাতে গুঁজে দিতে পারেন সাদা গাজরা অথবা রুপার কাঁটা। জরোয়া গহনার বদলে গলা, কানে, হাতে পরে নিতে পারেন হালকা ওজনের রুপা কিংবা গোল্ড প্লেটের গহনা। গলায় কয়েক লহরের চেইন পরুন। চোখ সাজাতে পারেন মোটা করে কাজল দিয়ে। ঠোঁটে দিন হালকা রঙের লিপস্টিক। কপালের একটু ওপরে পরুন ছোট্ট টিপ। ব্যস, হয়ে উঠুন অনন্যা।
আলতায় রঙিন: পূজার সাজের সঙ্গে আলতার সম্পর্ক নিবিড়। দশমীর দিনে এক প্যাঁচে পরিহিত লাল-সাদা শাড়ির সঙ্গে পায়ে বুলিয়ে নিন আলতা। হাতের তালু, পাঁচ আঙুলে দুই কোর ভরে আলতা পরে নিন। পায়ে পরুন নূপুর অথবা পায়েল।
বাহারি গহনা : পূজার আনন্দ দ্বিগুণ বাড়ায় সাজগোজ। পোশাকের সঙ্গে মিল রেখে মানানসই গহনা বেছে নিন। কুর্তি, কুর্তা, কাফতান, ওয়ান পিস, কোঅর্ডের সঙ্গে পুঁতি, অ্যান্টিক, পাথর, কড়ি ও অক্সিডাইজের গহনা বেছে নিতে পারেন। কড়ির গহনা পরা যাবে শাড়ির সঙ্গেও। এখন শাড়ির সঙ্গে পার্ল, গোল্ড প্লেট ও পার্লের মিশেলে গহনা, রুপা ও ধাতবের গহনা বেশ ট্রেন্ডে আছে। পছন্দের দুল, কানপাশার সঙ্গে গলায় চোকার, কয়েক লেয়ারের চেইন ও কম ওজনের সীতাহার বেছে নিতে পারেন। নতুন শাঁখা-পলা: পূজাকে কেন্দ্র করে সারা বছরের জন্য নান্দনিক শাঁখা ও পলা কিনে নিন। পূজার দিনগুলো তো বটেই; অন্যান্য সাধারণ দিনেও হাত সাজান শাঁখা-পলায়। আগে কেবল লাল রঙের পলার কদর বেশি ছিল। এখন বিবাহিত নারীদের মতো অবিবাহিতরাও পরেন সবুজ, বেগুনি ও অন্যান্য রঙের পলা। শাঁখারীবাজার ও বিভিন্ন অনলাইন পেজে বাহারি রঙের পলা পাওয়া যায়। চুড়ি ও ব্রেসলেটের সঙ্গেও পলা ও শাঁখা পরা যায়। নির্ভর করবে আপনি কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করছেন তার ওপর।