কাজী সালমা সুলতানা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন বিদেশি বন্ধু ওডারল্যান্ড। জীবনে দুটি যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন তিনি। প্রথমটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) ওলন্দাজ বাহিনীর গেরিলা কমান্ডো হিসেবে, পরেরটি বাঙালিদের পক্ষে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। তিনি একমাত্র বিদেশি যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সরকার কর্তৃক ‘বীরপ্রতীক’ রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হন। উইলিয়াম ওডারল্যান্ড যতদিন বেঁচে ছিলেন ‘বীরপ্রতীক’ উপাধিটি সবসময় তার নামের সঙ্গে ব্যবহার করেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধে দেশের প্রায় সব মানুষ অংশগ্রহণ করে। দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী দেশের এই মুক্তিযুদ্ধে অনেক বিদেশি মানুষ সেসময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। যারা এই দেশের মানুষ না হয়েও এই দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করেছেন, তাদের কেউ কূটনীতিক হিসেবে, কেউ স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে, কেউ সাংবাদিক হিসেবে, আবার কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে লড়েছেন। এমনই একজন মুক্তিযোদ্ধার নাম ডব্লিউ এএস ওডারল্যান্ড।
উইলিয়াম ওডারল্যান্ড ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে জš§গ্রহণ করেন। তার পুরো নাম উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ওডারল্যান্ড। তার পিতৃভূমি অস্ট্রেলিয়ায়। ১৯৩৪ সালে ওডারল্যন্ড বাটা শু কোম্পানিতে সু-শাইনারের চাকরি নেন। ১৯৩৬ সালে যোগ দেন জাতীয় সেনাবাহিনীতে। ১৯৪০ সালে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে ওলন্দাজ-অস্ট্রেলীয় বাহিনীর গেরিলা কমান্ডো হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) অংশগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি নেদারল্যান্ডসের একজন রেডিও টেকনিশিয়ান এবং গোলা-বারুদ ও সমর বিশেষজ্ঞ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান।
১৯৭০ সালে ওডারল্যান্ড বাটা শু কোম্পানির প্রডাকশন ম্যানেজার হিসেবে ঢাকায় আসেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি কোম্পানি ম্যানেজার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ মেঘনা টেক্সটাইল মিলের সামনে শ্রমিক-জনতার মিছিলে পাকিস্তান সেনাসদস্যরা শ্রমিক-জনতার ওপর গুলি চালায়। পরে ভয়াল ২৫ মার্চের কালরাতে গণহত্যাসহ সবকিছুই তিনি প্রত্যক্ষ করেন। তখনই তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৭০ সালে ওডারল্যান্ড বাটা শু কোম্পানির প্রডাকশন ম্যানেজার হিসেবে ঢাকায় আসেন। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি কোম্পানি ম্যানেজার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ মেঘনা টেক্সটাইল মিলের সামনে শ্রমিক-জনতার মিছিলে পাকিস্তান সেনাসদস্যরা শ্রমিক-জনতার ওপর গুলি চালায়। পরে ভয়াল ২৫ মার্চের কালরাতে গণহত্যাসহ সবকিছুই তিনি প্রত্যক্ষ করেন। তখনই তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন।
সে লক্ষ্যে প্রথমে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন এবং শুরু করেন ঢাকা সেনানিবাসে যাওয়া-আসা। এতে অনেকের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক হয়। একপর্যায়ে লেফট্যানেন্ট জেনারেল টিক্কা খান, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলিসহ আরও অনেক সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেন। নিয়াজীর ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্স তাকে ‘সম্মানিত অতিথি’ হিসেবে সম্মানিত করেন। এই সুযোগে তিনি সব ধরনের ‘নিরাপত্তা ছাড়পত্র’ সংগ্রহ করে ফেলেন। এই ছাড়পত্র কাজে লাগিয়ে সব জায়গায় অবাধে প্রবেশ শুরু করেন তিনি। এমনকি কারফিউ চলাকালেও তিনি যে কোনো জায়গায় যেতে পারতেন। সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণেরও সুযোগ পেতেন তিনি।
একপর্যায়ে তিনি পাকিস্তানিদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করতে শুরু করেন। তারপর পাকিস্তানি সেনাদের পরিকল্পনাগুলো তিনি গোপনে প্রেরণ করেন ২নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্সে ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দারের কাছে। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধকালীন মুহূর্তে তিনি পাকিস্তানি রণকৌশল ও পদ্ধতি-সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীর কাছে সরবরাহ করেন।
পরবর্তীকালে ওডারল্যান্ড সরাসরি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা কমান্ডো হিসেবে স্বীয় অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে এবং নিজে ২নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা শাখার সক্রিয় সদস্যরূপে অকুতোভয় ওডারল্যান্ড বাটা ফ্যাক্টরি প্রাঙ্গণসহ টঙ্গীর কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দেন। পাশাপাশি তিনি মুক্তিযুদ্ধের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে পাকবাহিনীর নৃশংস নির্যাতন ও গণহত্যার আলোকচিত্র তুলে গোপনে বহির্বিশ্বের বিভিন্ন তথ্য-মাধ্যমে পাঠাতে শুরু করেন। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি বিরাট অবদান রাখেন। এ ব্যাপারে ওডারল্যান্ড লিখেছেন, ‘ইউরোপের যৌবনের অভিজ্ঞতাগুলো যেন আমি নিজের মধ্যে ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে বিশ্ববাসীকে সেসব জানানো উচিত।’
মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রিজ ও কালভার্ট ধ্বংস করে দেন। ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোয় বহু অপারেশন সংঘটিত হয়, যার অনেকগুলোই ছিল ওডারল্যান্ডের পরিকল্পনা অনুযায়ী। উইলিয়াম ওডারল্যান্ড ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ঢাকায় বাটা শু কোম্পানিতে চাকরিরত ছিলেন। তখন তিনি কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি ফিরে যান তার নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় পার্থের এক হাসপাতালে ২০০১ সালের ১৮ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের শেষ দিনগুলোয় প্রায়ই তিনি তার স্ত্রী ও কন্যাকে বলতেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের ভালোবাসা; পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে আবেগের এ ধারা অব্যাহত রেখো।’
সূত্র : শেয়ারবিজ