১০ এপ্রিল, ১৭৫৫। ইতিহাসের পাতায় এক উল্লেখযোগ্য দিন। এদিন জার্মানির মাইসেন শহরে জন্ম নেন চিকিৎসা জগতের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, ড. ক্রিস্টিয়ান ফ্রিডরিখ স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। তিনি ছিলেন একজন নিঃশব্দ বিপ্লবী, যিনি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রচলিত ধারা থেকে সরে এসে একটি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির জন্ম দিয়েছিলেন যার নাম হোমিওপ্যাথি। আজও তার এই সৃষ্টি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জন্য আশার আলো হয়ে আছে।
ড. হ্যানিম্যান ছিলেন পেশাগতভাবে একজন অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি উপলব্ধি করেন, প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই বোধ থেকেই তিনি এক ভিন্ন চিকিৎসা ভাবনার দিকে ধাবিত হন। তার গভীর চিন্তা, গবেষণা এবং পরীক্ষার মাধ্যমে গড়ে ওঠে হোমিওপ্যাথির মূল দর্শন ‘সিমিলিয়া সিমিলিবাস কারেন্টর’ বা ‘লাইক কিওরস লাইক’ অর্থাৎ যে উপাদান সুস্থ ব্যক্তির দেহে কোনো বিশেষ লক্ষণ তৈরি করে, সেটিই যদি ক্ষুদ্রমাত্রায় অসুস্থ ব্যক্তিকে দেওয়া হয়, তবে শরীর নিজেই সেই লক্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
১৭৯৬ সালে তিনি প্রথমবারের মতো এই চিকিৎসা পদ্ধতির রূপরেখা প্রকাশ করেন। ধীরে ধীরে তার এই বিকল্প চিন্তা এবং প্রাকৃতিক নির্যাসভিত্তিক চিকিৎসা গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করে। হ্যানিম্যান বিশ্বাস করতেন, শুধু রোগের বাহ্যিক লক্ষণের চিকিৎসা নয়, বরং রোগীর মানসিক অবস্থা, শারীরিক অবস্থা এবং পরিবেশ এই সব কিছু মিলিয়ে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিকিৎসা দিতে হবে। এটাই ছিল তার হোমিওপ্যাথির মূল দর্শন।
হ্যানিম্যানের জন্মদিন ১০ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় ‘বিশ্ব হোমিওপ্যাথি দিবস’ হিসেবে। এদিন শুধু তার অবদানকে স্মরণ করাই নয়, বরং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার কার্যকারিতা, গবেষণা ও সমাজে এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা আয়োজন করা হয়। এই দিন থেকেই শুরু হয় বিশ্ব হোমিওপ্যাথি সচেতনতা সপ্তাহ, যা ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়া ও জার্মানিতে হোমিওপ্যাথি আজ একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও স্বীকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তো একাধিক হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। যদিও এ চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কও রয়েছে, তবে বহু গবেষণা ও অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা ও জটিল রোগে এটি সহায়ক ও কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
এই দিবস উপলক্ষে দেশ-বিদেশে আয়োজন করা হয় সেমিনার, ওয়ার্কশপ, আলোচনা সভা। অংশ নেন চিকিৎসক, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা। তারা হোমিওপ্যাথির বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং এটি আরও বিজ্ঞানসম্মত করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তা নিয়ে মত বিনিময় করেন।
হোমিওপ্যাথি কেবল একটি চিকিৎসা পদ্ধতি নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য দর্শন। এই পদ্ধতি দেহ, মন ও আত্মার সমন্বিত সুস্থতায় বিশ্বাসী। যেখানে প্রতিটি রোগীকে একজন ব্যক্তিস্বরূপ বিবেচনায় এনে চিকিৎসা প্রদান করা হয়, ঠিক একই ওষুধ দিয়ে নয় বরং রোগীর লক্ষণভেদে ভিন্ন ভিন্ন ওষুধ নির্ধারিত হয়।
ড. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান শুধু একজন চিকিৎসক ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বাসের স্থপতি, বিকল্প চিন্তার পুরোধা। তার এই নতুন চিকিৎসা দর্শন মানবজাতির জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তার জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করাই নয়, হোমিওপ্যাথির প্রতি সচেতনতা, গবেষণা এবং এই পদ্ধতির ভবিষ্যৎ বিকাশেও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
এই বিশ্ব হোমিওপ্যাথি দিবস হোক হানেমানের দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং ভবিষ্যতে একটি কার্যকর, মানবিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতির দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
তথ্যসূত্র: ব্রিটানিকা, এনসিসিআইএইচ