জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন আন্দোলন-সংগ্রামে না হয় জেলে। পঞ্চান্ন বছরের জীবন প্রায় ১৩ বছরই জেলের মধ্যে কেটেছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। আটটি জন্মদিন কেটেছে বন্দীদশায়। এই ত্যাগ-তিতিক্ষার পুরোটাই শ্রেণিশোষণ আর বাংলার মানুষের মুক্তির দাবিতে।
পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত জীবন বিসর্জনের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা নিয়ে আসলেন ঠিকই কিন্তু বেশিদিন আর স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে শ্বাস নেওয়া হয়নি তার। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে দুইকন্যা শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা ছাড়া পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে প্রাণ হারান বাঙালির অবিসংবাদিত এই নেতা।
নিজের জন্মদিন নিয়ে অবশ্য কোনদিনই খুব একটা উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করতো না তাঁর। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় তিনি লেখেন, ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস!’ আর বাইরে থাকলেও চেষ্টা করতেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অনাড়ম্বরে পালন করতে।
প্রাণের চেয়েও প্রিয় বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর মাত্র চারটি জন্মদিন পালনের সুযোগ মিলেছিলো। এর ঠিক এক বছর আগে ভয়াল একাত্তরের মার্চেই ছিলো তার ৫২তম জন্মবার্ষিকী। সেদিন তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সময় একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। এর জবাবে বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আজ আমার জন্মদিন। তবে ৫৩তম নয়। পত্রিকায় ভুল ছাপা হয়েছে, আজ আমার ৫২তম জন্মদিন’।
তখন একজন বিদেশি সাংবাদিক জন্মদিন পালনের প্রসঙ্গ তুললে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার জন্মদিনের উৎসব পালন করি না। এই দুখিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই বা কী, আর মৃত্যুদিনই বা কী? আপনারা বাংলাদেশের অবস্থা জানেন। এ দেশের জনগণের কাছে জন্মের আজ নেই কোনও মহিমা। যখনই কারও ইচ্ছা হলো আমাদের প্রাণ দিতে হয়। বাংলাদেশের জনগণের জীবনের কোনও নিরাপত্তাই তারা রাখেনি। জনগণ আজ মৃতপ্রায়। আমার আবার জন্মদিন কী? আমার জীবন নিবেদিত আমার জনগণের জন্যে। আমি যে তাদেরই লোক’।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি জন্মদিন পালন করেন না। জন্মদিনে মোমবাতিও জ্বালান না, কেকও কাটেন না। ওই সময় সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের প্রত্যাশা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি’।
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিন। স্বাধীন বাংলার মাটিতে জাতির পিতার প্রথম জন্মদিন। তবে সেদিনও বরাবরের মতোই অনাড়ম্বর আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয় বাঙালির মুক্তির দূতের জন্মদিন। এর কারণ হতে পারে, বঙ্গবন্ধু হয়তো সেটি প্রত্যাশা করেননি বা হতে দেননি। আরও একটি কারণ ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সেদিনই উপস্থিত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানকারী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ফলে দিনটি ব্যাপক ব্যস্ততার মধ্যেই কাটাতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। তবে সেদিন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ৫৫ কোটি ভারতবাসীর পক্ষ থেকে ফলমূল ও মিষ্টান্ন উপহার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আয়োজনকে দিয়েছিলেন ভিন্নমাত্রা।
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ‘বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব হউন’ শিরোনামে ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ছাত্র ও সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জাতির পিতার জন্মদিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ বেতার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কয়েকটি বিশেষ অনুষ্ঠানও প্রচার করে। সকাল ১০টায় ‘অন্তরঙ্গ সংলাপ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর বাল্যকাল এবং যৌবনকালের কথামালা প্রচারিত হয়। এতে বঙ্গবন্ধুর পিতা-মাতা, বন্ধু-বান্ধব এবং স্বগ্রামের বয়স্ক মানুষদের সাক্ষাৎকারও প্রচারিত হয়। রাত একটায় বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশবিশেষ প্রচারিত হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্পোরেশন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বিশেষ অনুষ্ঠানাদি প্রচার করে। এর মধ্যে ছিল সন্ধ্যা ৬.৪০ মিনিটে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের অনুষ্ঠান। ৮.৩০ মিনিটে প্রচারিত হয় বঙ্গবন্ধুর পিতা-মাতার সাক্ষাৎকার।
সেদিন ছিল সরকারি ছুটি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজের জন্মদিন উপলক্ষে সরকারি ছুটির বিপরীতে দিনটিকে কঠোর শ্রম ও বৃহত্তর কল্যাণে আত্মনিয়োগের জন্য বিশেষভাবে পালনের পক্ষপাতি ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানার্থে সেদিন সরকারি ছুটি থাকলেও ভবিষ্যতে যেন সেটি আর না হয় সেজন্য একটি বিবৃতি দিয়েছিলন। ১৭ মার্চ ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ছুটি থাকিবে না’ শিরোনামে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল (বৃহস্পতিবার) বলেন যে, ভবিষ্যতে তাহার জন্মদিন আর সরকারী ছুটির দিন হিসেবে উদ্যাপিত হইবে না। এই দিনটি কঠোর শ্রম ও বৃহত্তর কল্যাণে আত্মনিয়োগের দিন হিসাবে পালিত হইবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আনন্দানুভূতির সাথে সাথে কোটি মানুষের হৃদয় আজ বাংলার মাটিতে আর একজনের শুভাগমনের আনন্দে উদ্বেল। তিরিশ লক্ষ নর-নারীর রক্তের আলেখ্যমাখা স্বাধীন বাংলার বুকে রক্তে রাঙ্গা রাখী বন্ধনে মিত্র মহান ভারতবর্ষে ছাপ্পান্ন কোটি মানুষের স্নেহ, প্রীতি ও ভালবাসার বাণী লইয়া শুভ পদার্পণ করিতেছেন আফ্রো-এশিয়া-ল্যাটিন আমেরিকার জনগণনন্দিত মহীয়সী নেত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলার ধ্বংসপূর্ণ পিঠে দাঁড়াইয়া সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর হৃদয়ের অর্ঘ্যে আজ তাঁহাকে জানাই স্বাগতম। জয় বঙ্গবন্ধু-জয় শ্রীমতী গান্ধী-জয় বাংলা।”
একই দিনের খবর থেকে জানা যায় সেদিন চার ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ. স. ম. আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন এক যৌথ বিবৃতিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে প্রধানমন্ত্রি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৫৩তম জন্মবার্ষিকীতে তার দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
স্বাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ জন্মদিন
দৈনিক ইত্তেফাকের ১৯৭৫ সালের ১৮ মার্চ সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ৫৫তম জন্মজয়ন্তী নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘বঙ্গবন্ধুর ৫৫তম জন্মজয়ন্তী: নেতার স্বপ্ন সফল করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা’ শীর্ষক সংবাদ থেকে জানা যায়, “গতকাল (সোমবার) ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৫তম জন্মবার্ষিকী। সমগ্র জাতি গভীর শ্রদ্ধার সহিত এই দিনটি পালন করে। এই দিন সরকারী ও বেসরকারী ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং দেশের বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির, গীর্জায় বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থা করা হয়।
বাকশাল, জাতীয় শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ মহিলা সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল প্রভৃতির আয়োজন করা হয়।নেতার জন্মদিনে আয়োজিত বিভিন্ন আলোচনাসভায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাইবার জন্য কর্মদ্যোগী হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বিদেশী কূটনৈতিক মিশনগুলির পক্ষ হইতেও বঙ্গবন্ধুকে মালাভূষিত করা হয়।
জন্মদিনে নেতাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য তাহার বাসভবন অভিমুখে ছিল জনতার স্রোত। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কমপক্ষে ৫০ হাজার লোকের সমাগম হয়। নেতা ও জনতার সম্মিলনে কোন বাধা ছিল না।ভোর সাড়ে ছয়টা হইতে ৩২নং রোডস্থ বাসভবনে নেতার সাক্ষাৎপ্রার্থীদের ভিড় শুরু হয়। কেহ ফুলের মালা, পুষ্পস্তবক, কেহবা জন্মদিনের কেক, মিষ্টিসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী লইয়া জাতির জনকের বাসভবনে উপস্থিত হন, শুভেচ্ছা জানান, মঙ্গল কামনা করেন। বঙ্গবন্ধু প্রফুল্লচিত্তে আগতদের সকলকেই সাক্ষাৎদান করেন ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সকাল ৭টা হইতে সোয়া ১১টা পর্যন্ত ৪ ঘণ্টাধিককাল ধরিয়া তিনি শুভার্থীদের সাক্ষাৎদান করেন। বাকশাল, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংস্থা আসিয়াছিল মিছিল সহকারে, দলবদ্ধভাবে।
বঙ্গবন্ধু পুষ্পমাল্যগুলি পাঠাইয়া দেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা, মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ভাষা আন্দোলনের শহীদানের মাজারে, শহীদ মিনারে এবং সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে। বঙ্গবন্ধু আগত সকলকেই দেশ গঠনে কঠোর পরিশ্রম করার উপদেশ দেন।
সকাল ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু সমবেত সকলের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার জন্মদিনে আমি ছুটি ঘোষণা করি নাই। তাই আজ আমি অফিসে যাইব, অল্পক্ষণের জন্য হইলেও অফিসের কাজ করিব।’ উপস্থিত সকলকে তিনি নিজ নিজ অফিসে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সকাল প্রায় সোয়া ১১টার সময় বঙ্গবন্ধু গণভবনের উদ্দেশ্যে বাসভবন ত্যাগ করেন।”
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, ইত্তেফাক এবং উইকিপিডিয়া