আজ ঘটনাবহুল ১৭ রমজান

ইতিহাস বদলে দেওয়া ‘বদর যুদ্ধ’ 

আসমা জান্নাত বীথি
  ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪:২১
ঐতিহাসিক বদর প্রান্তর

আজ ১৭ রমজান। দ্বিতীয় হিজরির এই দিনে মুসলিম ইতিহাসের মোড় পাল্টে যায়। কারণ এদিন মদিনার উপকণ্ঠে বদর নামক স্থানে মুখোমুখি হয়েছিল মুসলিম কাফেলা এবং অমুসলিম শক্তি কুরাইশ বাহিনী। মদিনার অদূরে একটি কূপের নাম ছিল বদর। সেই সূত্রে কূপটির নিকটবর্তী অঞ্চলও একই নামে পরিচিত পেয়েছিল। এখানেই সংঘটিত হয় যুদ্ধ। ঐতিহাসিক এ যুদ্ধ ছিল ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্বের সংগ্রাম; যা হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেই পরিচালনা করেন। এটি ছিল সত্য ও মিথ্যা; হক ও বাতিল এবং মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যকার যুদ্ধ। এর ফলে ইসলামে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। পবিত্র কোরআনের দুটি সুরায় বদর যুদ্ধের বর্ণনা এসেছে।
ঘটনার সূত্রপাত
সেসময় মক্কার পরে মদিনাতেও ফুটে উঠেছিল ইসলামি বসন্ত। যা বেশ ভাবিয়ে তোলে মক্কার কাফেরদের। কারণ ওরা জানতো, এই বসন্ত দাবানলে রূপ নিয়ে তাদের জ্বালিয়ে দেবে। বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের অন্যায় ব্যবসার পথে। তাই মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে অর্থ জোগান ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র কিনতে সিরিয়া গিয়েছিল মক্কার একটি বাণিজ্য কাফেলা। যার নেতৃত্ব দিচ্ছিল আবু সুফিয়ান। মক্কার প্রতিটি ঘর থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছিল ১ হাজার মালবাহী উটের এই বাণিজ্য বহর। যার পাহারায় ছিল ৪০ জন সশস্ত্র অশ্বারোহী যোদ্ধা। বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিল মুসলিমরাও। তাই যখন তারা সিরিয়া থেকে বাণিজ্য শেষে বিপুল অর্থ ও সমরাস্ত্র নিয়ে ঘরে ফিরছিল, সিদ্ধান্ত হয় তাদের গতিরোধ করা হবে। আত্মরক্ষার্থে এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না মুসলিমদের সামনে।
বিষয়টি টের পেয়ে দ্রুত সাহায্যের জন্য মক্কায় খবর পাঠায় আবু সুফিয়ান। সঙ্গে সঙ্গে আবু জাহেলের নেতৃত্বে ১ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার এক বিশাল বাহিনী বের হয় মদিনা আক্রমণ করতে। অথচ মুসলিমরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আসেনি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্য কাফেলাকে আটকানো। এ ছাড়াও যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে প্রত্যক্ষ আরও কিছু কারণও ছিল। যেমন নাখলার খণ্ডযুদ্ধ, কাফেরদের রণপ্রস্তুতি, আবু সুফিয়ানের অপপ্রচার, যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য ওহি লাভ ও মক্কাবাসীর ক্ষোভ ইত্যাদি।
আর পরোক্ষ কারণ ছিল, মদিনায় ইসলামের সাফল্যে কুরাইশদের হিংসা, আবদুল্লাহ বিন উবাই ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, কুরাইশদের যুদ্ধের হুমকি, বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা, আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা, ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তির ধ্বংসসাধন এবং রাসুলুল্লাহকে (সা.) চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার অশুভ বাসনা।
মুখোমুখি হলো উভয় দল
নবিজি হজরত মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, সেনাবিন্যাস করলেন। মুখোমুখি হলো উভয় বাহিনী। কাতার সোজা করার পর নবিজি (সা.) বললেন, ‘আমার নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত কেউ যুদ্ধ শুরু করবে না। মুশরিকরা যখন দলবদ্ধভাবে তোমাদের কাছে আসবে, তখন তাদের প্রতি তির নিক্ষেপ করবে। অবশ্য তিরের অপচয় যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখবে। তারা তোমাদের ঘিরে না ফেলা পর্যন্ত তরবারি চালাবে না।’ 
এমন সময় কাফের আসওয়াদ ইবনে আবদুল আসাদ মাখজুমি ময়দানে এসে বলল, ‘আল্লাহর কসম! ওদের পানি পান করতে দেবো না। না হয় হাউজকে ধ্বংস করে দেব। অথবা এজন্য জীবন দেবো।’ তখন হামজা (রা.) আসওয়াদকে হত্যা করে ফেললেন। ছড়িয়ে পড়লো যুদ্ধের আগুন। কুরাইশ বাহিনী থেকে বেরিয়ে এলো তিন জন বিশিষ্ট যোদ্ধা। রবিয়ার পুত্র ওতবা ও শায়বা এবং ওতবার পুত্র ওয়ালিদ। তাদের মোকাবিলায় বের হলেন তিন আনসার সাহাবি। কুরাইশরা বললো, আমরা স্ববংশীয় কুরাইশদের সঙ্গে লড়াই করতে চাই। তখন নবিজি ওবাদা ইবনুল হারিস, হামজা ও আলীকে (রা.) এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। যুদ্ধে কাফেররা নিহত হলো। আর হামজা ও আলী অক্ষত অবস্থায় ফিরে এলেও ওবাদা (রা.) আহত হয়ে পরে শাহাদাৎ বরণ করেন। 
এরপর শুরু হলো সর্বাত্মক যুদ্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই অমুসলিম বাহিনীর ব্যর্থতা ও হতাশার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠল। মুসলিম বীরদের প্রবল আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল তারা। যুদ্ধের পরিণাম হয়ে উঠল সুস্পষ্ট। অন্যদিকে নবিজি মুসলিম বাহিনীকে উদ্দীপ্ত করে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যের সুসংবাদও দিলেন। আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা প্রেরণ করলেন মুসলিম বাহিনীর সাহায্যে। আল্লাহর সাহায্য ও মুসলিম বাহিনীর বীরত্বের কাছে করুণ পতন হলো দাম্ভিক কুরাইশদের। নিহত হলো ৭০ জন কুরাইশ। আর বন্দি হলো সমপরিমাণ। আর শহিদ হলেন ১৪ জন (ছয়জন মুহাজির, আটজন আনসার) মুসলিম মুজাহিদ।
পবিত্র কোরআনে বদর যুদ্ধ
পবিত্র কোরআনের সুরা আল-ইমরান ও সুরা আনফালে বদর যুদ্ধের সবিস্তার বর্ণনা এসেছে। সুরা আল ইমরানে মুসলিমদের অবস্থা, আল্লাহর সাহায্য ও তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ভবিষ্যতেও সাহায্য করার ঘোষণা দিয়ে বদর যুদ্ধের অবস্থা তুলে ধরে বলেন : আল্লাহ তোমাদের বদরে সাহায্য করেছেন। অথচ তোমরা ছিলে ক্ষীণশক্তি। [সুরা আল ইমরান, আয়াত : ১২৩]
সুরা আনফলে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের সাহস জোগাতে গিয়ে বলেন, ‘স্মরণ কর! যখন আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন, তারা সংখ্যায় অল্প। যদি তিনি তাদের সংখ্যায় বেশি দেখাতেন; তবে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলতে এবং যুদ্ধের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি করতে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা রক্ষা করেছেন। নিশ্চয় তিনি অন্তরের খবর জানেন।’ [সুরা আনফাল, আয়াত : ৪৩]
মহান আল্লাহ এই যুদ্ধকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ তথা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টকারী দিন বলে আখ্যা দিয়েছেন। আল্লাহর এই নামকরণ থেকেই বদর যুদ্ধের প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। মূলত প্রতিষ্ঠিত শক্তি কুরাইশদের বিরুদ্ধে সদ্যগঠিত মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য বদর ছিল অস্তিত্বের লড়াই। বদর যুদ্ধের বিজয় ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রথম রাজনৈতিক স্বীকৃতি। এ যুদ্ধই ইসলামি রাষ্ট্রের পথচলার গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়। এই যুদ্ধ শুধু মদিনা নয়; বরং গোটা আরবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করে।
রক্ত স্রোতের মাঝেও জ্ঞানের আলো
বদর যুদ্ধে ৭০ জন কুরাইশ বন্দিকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তখন আল্লাহ তাআলা মুক্তিপণ গ্রহণকে হালাল ঘোষণা করেন। মুক্তিপণের পরিমাণ ছিল ১ থেকে ৪ হাজার দিরহাম পর্যন্ত। যাদের মুক্তিপণ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাদের পেশাগত দক্ষতার বিনিময়ে মুক্তির সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন- শিক্ষিত বন্দীদের মদিনায় ১০টি করে শিশুকে লেখাপড়া শেখানোর বিনিময়ে মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়।  
‘বদরি সাহাবিদের’ মর্যাদা
বদর যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মুসলিমদের জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল নিজেকে মৃত্যু ও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার নামান্তর। কেননা বাহ্যিক সব পরিসংখ্যানে এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর পরাজয় ছিল অবধারিত। কিন্তু ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্ব রক্ষায় যারা নিজেদের নিশ্চিত পরাজয় ও মৃত্যুর মুখে সমর্পণ করেছিলেন আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের সম্মানীত করেন। পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াত এবং অসংখ্য হাদিস দ্বারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মর্যাদা প্রমাণিত। যেমন: জিবরাইল (আ.) নবী করিমের (সা) কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কীভাবে মূল্যায়ন করেন?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সর্বোত্তম মুসলিম হিসেবে অথবা অনুরূপ কিছু।’ জিবরাইল বললেন, ‘ফেরেশতারাও অনুরূপ মনে করে।’ [বুখারি,  হাদিস : ৩৭৭১]
প্রিয়নবী (সা.) বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ক্ষমার সুসংবাদ দান করে বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে অবগত আছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের যা ইচ্ছা করতে পারো। আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি।’ [বুখারি, হাদিস : ৩০০৭; মুসলিম, হাদিস : ২৪৯৪]
ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘এমন মহান সুসংবাদ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছাড়া আর কেউ পায়নি।’ [ফাতহুল বারি : ৭/৩০৫]
একজন দাস রাসুলের (সা.) কাছে এসে নালিশ করে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! নিশ্চয় হাতেব জাহান্নামে যাবে।’ রাসুল সা. বললেন, ‘তুমি মিথ্যা বলেছো। সে জাহান্নামে যাবে না। কেননা সে বদর ও হুদাইবিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিল।’ [মুসলিম, হাদিস : ২৪৯৫]
বদর যুদ্ধের অংশগ্রহণকারীদের এমন সম্মান ও মর্যাদার কারণ ব্যাখ্যা করে আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘এটা নিছক কোনও যুদ্ধ ছিল না। এটা ছিল ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এর প্রকৃত রূপ ছিল অকল্পনীয় কঠিন। প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এ জন্য প্রিয়নবী (সা.) তাদের উচ্চ মর্যাদার ঘোষণা দিয়েছেন। [আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ৫/২৫৮]
বদর প্রান্তরে সত্য-মিথ্যা, ঈমান ও কুফরের মাঝে একটি দেয়াল রচিত হয়, যা মুসলিমদের জন্য প্রেরণার উৎস। মুসলিমরা বিশ্বাস করেন, জয়-পরাজয় আল্লাহর হাতে। সম্মান-অপমানও তার হাতে। এ বিশ্বাস ও চেতনা লালন করে পৃথিবীর যে প্রান্তে যখনই মুসলিমরা অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, সংখ্যা বা সম্পদে কম হলেও আল্লাহ তাদের বিজয় দান করেছেন। পক্ষান্তরে আল্লাহর ওপর ভরসাহীন অঢেল সম্পদ ও বিপুল সৈন্য-সামন্তের বাহিনী পরাজিত হয়েছে চোখের সামনে।
বদরের শিক্ষা হলো, মুসলিমর এমন একটি জাতি, যারা নীরবে নিভৃতে অত্যাচার-অনাচার-জুলুম সহ্য করাকে ভয়াবহ গোনাহ মনে করে। প্রয়োজনে জীবন দিয়ে হলেও সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা তাদের অন্যতম কর্তব্য।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষিকা, রাশাদ মহিলা মাদ্রাসা, কে, ৭/এ, বর্ধিত পল্লবী, মিরপুর, ঢাকা।