নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল ইসলিপের ফেডারেল প্লাজা। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ফেডারেল কোর্টহাউসের বিশাল সেরেমনিয়াল কোর্টরুম। মেঝে থেকে ছাদের বিশাল উচ্চতা যেন এই কামরায় অনুষ্ঠিত সমস্ত কর্মকাণ্ডের সীমাহীন এবং সুউচ্চ গুরুত্বেরই প্রতীক। আমি এবং আমার জীবনসঙ্গী অপু তৃতীয় সারিতে আমাদের জন্য সংরক্ষিত চেয়ার দুটো খুঁজে নিয়ে বসে পড়ি। যে কারণে আমরা আটলান্টিক মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে সুদূর ম্যানচেস্টার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের লং আইল্যান্ডে ছুটে এসেছি, সেই বহু প্রতীক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণটি অবশেষে উপস্থিত হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অপুর অত্যন্ত আদরের চাচাতো বোন এবং আমার স্নেহের ননদ নুসরাত জাহান চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মুসলিম নারী এবং প্রথম বাংলাদেশী আমেরিকান ফেডারেল বিচারক হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন।
কোর্টরুমে তিল ধারণের স্থান নেই। এই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হতে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে এসেছেন নুসরাতের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ল’ স্কুলের সহপাঠী ও প্রাক্তন এবং বর্তমান সহকর্মীগণ। মঞ্চে আসীন রয়েছেন সম্মানিত ফেডারেল বিচারকগণ। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে প্রথম সারিতে আসীন রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা সম্মানিত চার্লস ই শুমার এবং নিউইয়র্কের সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্টের সম্মানিত বিচারক ডেনিস কোট যার ল’ ক্লার্ক হিসেবে দেড় যুগ আগে নুসরাত চৌধুরীর এই গৌরবময় যাত্রা শুরু হয়েছিল। দীর্ঘদিন বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক পদে নিয়োজিত থাকার পর ২০২১ সালে চার্লস শুমার নুসরাতকে ফেডারেল জাজ হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে প্রস্তাব দেন, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে জো বাইডেন তাকে ফেডারেল জাজ হিসেবে মনোনীত করেন এবং ২০২৩ সালে সেই মনোনয়ন নিশ্চিত করা হলে নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত সকল মানুষের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। অবশেষে ২০২৪ সালের ১০ মে তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় যেখানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের আপীল কোর্টের সিনিয়র সার্কিট জাজ সম্মানিত বারিংটন ডি পার্কার নুসরাত চৌধুরীকে শপথ গ্রহণ করানোর পর তার পরিবার- মা নাফিসা চৌধুরী, দুই ভাই আরিফ চৌধুরী ও সাইফ চৌধুরী, স্বামী মাইক আর্লি এবং তার এক বছর বয়েসী পুত্র রাফি আর্লি চৌধুরী সম্মিলিতভাবে তাকে ফেডারেল জাজের রোব অর্থাৎ গাউন পরিয়ে দেন। শপথ গ্রহণের আগে এবং পরে বিচারক নুসরাত চৌধুরীর এই গৌরবময় অর্জন নিয়ে বক্তব্য রাখেন বিচারক প্যামেলা কে চেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রাক্তন বিশেষ সহকারী পেইজ হারউইগ, সিনেটর চার্লস ই শুমার, সাইফ চৌধুরী, আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের লিগ্যাল ডায়রেক্টর ডেভিড কোল সহ আরো অনেকে।
আমেরিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত সম্মানিত ব্যক্তিদের বক্তব্য শুনতে শুনতে আমি বুঝতে পারি আমরা যে নুসরাতকে জানি- যে নুসরাত আমাদের মেয়ে, আমাদের আত্মীয়, আমাদের পরিবারের এবং জাতির গর্ব, সেই নুসরাত আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক উপরে, অনেক বেশি বড় একজন মানুষ। বিচারক চেন বলেন ১৭৮৯ সালে জুডিশিয়ারি আইন দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্ট সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত হবার প্রায় ২৩৫ বছর পর এই প্রথম একজন মুসলিম নারী অথবা বাংলাদেশী আমেরিকান ব্যক্তি ফেডারেল জাজ হিসেবে নিয়োগ পেলেন- এই হিসেবে নুসরাত বাস্তবিক অর্থেই ইতিহাস রচনা করেছেন।
২০০৬ সালে একই বছরের মধ্যে একাধারে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ইন পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন এবং ইয়েল ল’ স্কুল থেকে জুরিস ডক্টর অর্জন করার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত নুসরাত বিচারক ডেনিস কোট এবং বিচারক বারিংটন ডি পার্কারের ল’ ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেন। এরপর দীর্ঘ একযুগ ধরে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের জাতীয় নিরাপত্তা প্রোজেক্ট এবং জাতিগত ন্যায়বিচার প্রোগ্রামের স্টাফ এটর্নি হিসেবে এবং পরবর্তীতে এই প্রতিষ্ঠানের লিগ্যাল ডায়রেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সম্মানিত চার্লস শুমার যথার্থই বলেন- একজন বিচারকের মধ্যে নিরপেক্ষতা, মুক্তমন এবং আইনি প্রক্রিয়ায় উদ্ভুত জটিল সমস্যাসমূহের উপর পরম দখল থাকতে হয় এবং বিচারক নুসরাত ঠিক সে ধরনেরই একজন মানুষ যিনি এই গুরুদায়িত্ব যথোপযুক্ত ভাবে পালন করতে পারবেন কারণ আইন পাশ করার পর চাইলেই তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারতেন, কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করার পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি ভেটেরান এবং অভিবাসীদের জন্য কাজ করেছেন, দেশ জুড়ে বিভিন্ন শহরে পুলিশি কর্মকাণ্ডের উন্নতির জন্য আইন প্রয়োগকারী বিভাগের সাথে কাজ করেছেন। শুমার বলেন, ‘She dedicated her career to protecting the rights of the downtrodden and making sure that all people- from the privileged to the impoverished- can have their voices heard.’ তিনি আরো বলেন- বাংলাদেশী কমিউনিটি হচ্ছে নিউইয়র্কের সবচেয়ে দ্রুততম বাড়তে থাকা, সবচেয়ে প্রাণবন্ত এবং চমৎকার কমিউনিটিগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং তিনি আশা ও বিশ্বাস করেন যে এই কমিউনিটির আরো অনেকেই নুসরাতের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন।
যা আমাকে সবচেয়ে বেশি ছুঁয়ে যায় তা হচ্ছে নুসরাতের পরিবারের প্রতি শুমারের শ্রদ্ধা প্রদর্শন। তার পরিবারের উদ্দেশ্যে একপ্রস্থ করতালি দিতে শুমারের অনুরোধ রক্ষা করতে কার্পণ্য করে না কেউ। বারবার কানে তালা লাগানো প্রচণ্ড করতালির মধ্যে প্রায় হারিয়ে যেতে থাকা শুমারের অনেকগুলো বাক্য আমার কানে মধুর মতো বাজে-
‘আমরা সবাই জানি ভালোবাসার মানুষদের সহযোগিতা ছাড়া কেউ এই অবস্থানে
পৌঁছুতে পারে না।’
‘এই পরিবারটি আমেরিকানদের স্বপ্নের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’
‘দুই প্রজন্ম ধরে কাঁচের ছাদ ভেঙ্গে চলেছে এই পরিবার।’
শুমারের বক্তব্য যথার্থ। নুসরাতের বাবা ডাক্তার নূরের রহমান চৌধুরী ছিলেন ফুলব্রাইট ট্র্যাভেল গ্র্যান্ট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসা প্রথম বাংলাদেশী ব্যক্তি। নুসরাতের মা নাফিসা চৌধুরীও একজন সফল কর্মজীবি নারী যিনি প্রায় দুই দশক ধরে পাবলিক স্কুল ফুড সার্ভিসের জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু শুমারের নাতিদীর্ঘ বক্তব্যে নুসরাতের বৃহত্তর পরিবারের কথা বলার সুযোগ হয়তো বা ছিল না। নুসরাতের শেকড় বাংলাদেশের এমন একটি পরিবারে যাদের মধ্যে সমাজসেবা এবং মানবকল্যানের একটি ধারা আগে থেকেই প্রচলিত রয়েছে। ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার বাগডুবি গ্রামের চৌধুরী বাড়ি একটি সম্ভ্রান্ত পরিবার হিসেবে সুপরিচিত। বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও মসজিদ প্রতিষ্ঠায় নুসরাতের পিতামহ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাগডুবি গ্রামে এই পরিবারের প্রতিষ্ঠিত ‘নূরজাহান, আজমত চৌধুরাণী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’, ‘বাণীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ এবং একটি মসজিদ পরিচালনায় এখনো পরিবারটির সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। নুসরাতের চাচা, আমার শ্বশুর, মুজিবুর রহমান চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত মানব কল্যাণ সোসাইটি ফেনী জেলার অসংখ্য দুস্থ মানুষকে দীর্ঘদিন যাবত সেবা প্রদান করে আসছে। আজ তিনি বেঁচে না থাকলেও তার ভক্ত অনুসারীদের উদ্যোগে এবং তার সন্তানদের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি এখনো জনকল্যাণে নিয়োজিত রয়েছে।
কথাপ্রসঙ্গে নুসরাত আমাকে তার নিজের ভাবনার কথা বলেন। তিনি চান তার অভিজ্ঞতার দ্বারা আমেরিকার এবং পৃথিবীর সকল জাতির মানুষ, বিশেষ করে বাংলাদেশী মেয়েরা এবং নারীরা শিক্ষা অর্জন করতে, কঠোর পরিশ্রম করতে, এবং ফেডারেল জাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সহ অন্যান্য সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দেশের সেবা করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে অনুপ্রাণিত হবে। নুসরাতের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে যায় মার্টিন লুথার কিং এর বিখ্যাত ‘I have a dream’ বক্তৃতার কথা। সেই স্বপ্নের হাত ধরেই কত শত সহস্র মানুষের কত ত্যাগ আর তিতিক্ষার ফসল ফেডারেল জাজ নুসরাতের আজকের এই অর্জন।
শপথ গ্রহণের পর বিচারকের গাউন পরে অন্যান্য ফেডারেল জাজদের সাথে এক সারিতে মঞ্চে গিয়ে বসার পর আমি গভীর শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে নুসরাতের দিকে তাকাই। এই নারীর সাথে আমি কত ঘুরে বেড়িয়েছি, খেয়েছি, হেসে গড়িয়ে পড়েছি, কতবার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছি- ভেবে আমার গায়ের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে যায়। আমার ছোটখাটো মিষ্টি ননদ নুসরাত, অথচ মানুষ হিসেবে তার প্রকৃত উচ্চতা মাপার যোগ্যতাই আমার নেই। অপুর দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখে আনন্দ আর গর্বের অশ্রু চিকচিক করছে। টের পাই আমার গাল বেয়েও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আমার জন্য এটা শুধু পারিবারিক বা জাতীয় গৌরব নয়। নারীর এবং সকল বঞ্চিত মানুষদের সমঅধিকার নিয়ে লড়ে যাওয়া একজন লেখক হিসেবে আমার জন্য এটা একটা আদর্শিক বিজয়, খুব কাছের একজন নারীর চূড়ান্ত ক্ষমতায়ন, যার হাত ধরে আরো অসংখ্য নারী অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হবার সাহস এবং অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবে। মার্টিন লুথার কিং এর মতো আমিও স্বপ্ন দেখি, আই হ্যাভ আ ড্রিম ট্যু!