মৌলভীবাজারের জলাভূমিতে শ্বেতসৌন্দর্য ছড়ায় দুর্লভ ‘বালিহাঁস’ 

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
  ২৩ মে ২০২৪, ১৩:৫৩

বহু বছর আগে কথা! তখন চা-বাগান বলে আসলে কিছুই ছিল না। না তো ছিল চা এর সবুজের গালিচা।
না তো ছিল চা এর সর্বশেষ ধাপ ‘ব্লেক-টি’, ‘গ্রিন-টি’! চারদিকে ছিল পাহাড় আর পাহাড়। বৃটিশরা তাদের শাসনামলে নিজেদের স্বার্থের জন্য এ অঞ্চলে চা-বাগান প্রতিষ্ঠা করে। সব মিলিয়ে আমাদের দেশে চায়ের ইতিহাস প্রায় দেড়শ’ বছরের কিছু বেশি।  
প্রায় প্রতিটি চা-বাগানে চায়ের সেচ সুবিধার জন্য বাগান প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে তৈরি করা হয়েছিল লেক বা হ্রদ। কেউ কেউ অবশ্য বিল বলে থাকেন। কয়েকটি পাহাড়ি টিলার নিচ অংশ কেটে কেটে সেই সব লেক তৈরি করা হয়েছিল। আজ সেগুলোতে এতটাই প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, নানান জীববৈচিত্র্য এখানে তাদের জীবন নির্বাহ করে প্রকৃতির প্রয়োজনীয়তা রক্ষায় নিরলস কাজ করে চলেছে।
চা বাগানে লেক মানেই বিশেষ কিছু। বিশেষ কিছুর প্রাপ্তিতা। পাখির কথাই যদি ধরা হয় তবে নানা প্রজাতির পাখিতে মুখরিত থাকে চা বাগানের এসব জলজ অঞ্চল। একটু অদেখা, একটু অচেনা জলচর পাখির কথা উল্লেখ করা হয় – তবে বলাই বাহুল্য ‘বালিহাঁস’ নামটি সগৌরবে তার সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠা করবে।
 কেননা, আরণ্যক পটভূমির সৌন্দর্যে সাথে মাখামাখি হয়ে এ জলচর পাখিটির দৈহিক সৌন্দর্য তাক লাগার মতোই! যা হৃদয়ে অসীম ভালোলাগার জন্ম দেয়। সম্প্রতি এক সকালে চা বাগানের এক লেকে বালিহাঁসের পানিতে চড়ে বেড়ানো প্রকৃতির মাঝে দারুণ সৌন্দর্য ছড়ালো। বর্তমানে এ বালিহাঁসগুলো কম দেখা যায়।
জন্মসূত্র হতে এক হয়ে থাকা একজোড়া বালিহাঁস প্রায় সারাজীবন অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জোড়া লেগে থাকে। ছেলে এবং মেয়ে পাখি দুটির এই মিলনবন্ধন প্রায় চিরকালীন। মানুষ নাম বিশেষ প্রাণী কর্তৃক জালফাঁদ বা বিষটোপের মাধ্যমে এক জোড়ার কোনো একটির অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঘটানো হলে অপর একাকী বালিহাঁস জোড়া বাঁধার আশায় নতুন কোনো দলের সাথে যুক্ত হয়।
নিজেদের নিরাপত্তা কিংবা নিজেদের দল ভারি করার জন্য ওরা জোড়ায় জোড়ায় এগিয়ে যায়। একজোড়া বালিহাঁস উড়ে গিয়ে অপর জোড়াদের সাথে মেশে। বৃদ্ধি পায় তাদের দলের সদস্যদের সংখ্যা। এভাবেই ওরা জলাশয়ে খাবারের সন্ধানে ধীরে ধীরে সাঁতার কেটে বেড়াতে থাকে।
‘বালিহাঁস’ এর ইংরেজি নাম Cotton Pygmy-goose এবং বৈজ্ঞানিক নাম Nettapus coromandelianus। ধলা বালিহাঁস বা বেলেহাঁস নামেও এদেরকে উল্লেখ করা হয়। ভাসমান জলজ উদ্ভিদ এরা খাদ্যগ্রহণ করে। জলজ উদ্ভিদের কচি ডাটা, মূল, বীজ, চিংড়ি, কাঁকড়া, ব্যাঙ, জলজ পোকামাকড় এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে।  


বালিহাঁস প্রায় ৩৩ সেন্টিমিটার থেকে ৩৭ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের হয়ে থাকে। ছেলে এবং মেয়ে বালিহাঁসের দৈহিক রঙের বিচিত্রতায় ভিন্নতা রয়েছে। ছেলে পাখির দেহ সাদা-কালো রঙে। গলায় মালার মতো কালো রঙের বৃত্তাকার দাগ রয়েছে। গ্রীষ্মকালে ছেলে পাখির মুখমণ্ডল, গলা ও পেটে সাদা রঙের উজ্জ্বলতা দেখা যায়। মেয়ে পাখিটির দেহ মেটে রঙের। পিঠের উপরিভাগ কালচে।
বালিহাঁস বাংলাদেশের ‘দুর্লভ আবাসিক’ পাখি। দেশের হাওর, বিলসহ নানা জলাভূমিগুলো বিপন্ন হওয়ায় এদের সংখ্যা এখন অনেকটাই কমে গেছে। প্রকৃতি থেকে এখন ধ্বংস হয়ে গেছে পুরাতন বড় বৃক্ষ, মন্দির বা প্রাচীন স্থাপনা। যেগুলোকে তারা প্রজনন-কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতো। আর কিছুদিন পরে হয়ত যে হাওর-বিলে ওরা ঘুরে বেড়াতো, সেখানে আর তাদের মাঝে মাঝেও দেখা যাবে না।