গত ফেব্রুয়ারিতে সস্ত্রীক দেশে গিয়েছিলাম। তিন সপ্তাহের সফরে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হলো। দেশের অবকাঠামোগত উন্নতি দেখে মন ভরে যায়। অনেকেই দেশকে নিয়ে নিগেটিভ কথা বলে। আমি তার ঘোর বিরোধী। তবে কষ্টের ব্যাপার যে দেশ অনেক এগিয়ে গেলেও দেশের মানুষগুলির মন-মানসিকতার এক বিন্দুও উন্নতি হয়নি। আদর-ভালোবাসা বা মনুষ্যত্ব বলতে কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবাই নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। স্বার্থ হাসিলের জন্য বা ধনী হওয়ার ধান্দায় যে কোন হীন কাজ করতে কারো বিবেকে বাধছে না। আর চক্ষুলজ্জা শব্দটা বোধহয় এখন ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে। একে অপরের প্রতি নূন্যতম শ্রদ্ধাবোধ নেই। কথায় কথায় সবাই হাতি-ঘোড়া মারে। উপড়ের লেভেলের কানেকশনের হুমকি দেয়। আমি একজন সাধারন প্রবাসী, মনের টানে দেশে যাই। আমার উপড়ের লেভেলে কেউ নেই বলে সব সময় দেশে গিয়ে কোনঠাসা হয়ে থাকি।
শুরুতেই ঢাকা এয়ারপোর্টে কাস্টমস্ গেইটে তিক্ত এক অভিজ্ঞতা হলো। কাস্টমস্-এ লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। বেশ লম্বা লাইন। এক যাত্রী তার পরিবার নিয়ে সরাসরি লাইনের মাঝে ঢুকার চেষ্টা করছে। লাইনের শেষ মাথা দেখিয়ে ওখানে যেতে বললাম। উনি নাছোড়বান্দা - লাইনের শেষ মাথায় না গিয়ে মাঝখানেই ঢুকবেন। বললাম যে আপনি নিয়ম না মেনে ঝামেলা করছেন কেন ? উত্তর দিলেন - আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। অবাক হলাম উনার আচরন দেখে। শুধু বললাম - আপনি মুক্তিযোদ্ধা বলে কি নিয়ম ভাঙ্গার লাইসেন্স পেয়ে গেছেন ? বাংগালিদের উপড় পাকিস্তানিদের অত্যাচার আর অনিয়মের প্রতিবাদে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন। অথচ আজ নিজেই অনিয়ম করছেন? কাস্টমস্ অফিসার আমাকে বললেন - স্যার, আপনি যান, কথা বলে লাভ নেই, অনিয়মটাই এখন নিয়ম হয়ে গেছে।
মেট্রো রেলের বদৌলতে ঢাকার উত্তরাঞ্চলের মানুষ এখন বিশ থেকে তিরিশ মিনিটে মতিঝিল পৌঁছতে পারে। এই রুটের মানুষ বাস কোম্পানির অত্যাচার থেকে রেহাই পেয়েছে। এক্সপ্রেস-ওয়ে ধরে এয়ারপোর্ট থেকে খুব অল্প সময়ে নিকেতন পৌঁছে গেলাম। কিছু লোককে দেখলাম যে এই সরকারকে পছন্দ করে না বলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি স্বীকার করে না। মন্দ কিছু বলতেই হবে। তাদের মন্তব্য - মেট্রোরেল ভালো নয় কারন ভাড়া বেশী। তাও ভালো বলবে না। আমরা ভালো কাজেও ত্রুটি খুঁজে বেড়াই। কথায় বলে - যারে দেখতে নারী, তার চলন বাঁকা।
ঢাকার বর্তমান প্রধান সমস্যা হলো ট্রাফিক ব্যবস্থা। কেউ কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করে না। অনেক ইন্টার-সেকশনে ফুট ওভারব্রীজ ব্যবহার না করে সব মানুষ রাস্তার মাঝ বরাবর পার হয়। শাহবাগ মোড়ে গাড়ী ঘুরিয়ে আসতে আমাকে পয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। মানুষের ভীড়ে গাড়ি চলার উপায় নেই। পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে বাস ড্রাইভাররা। ইচ্ছেমত যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানামা করে। রিকশা আর সিএনজি-র সাথে নতুন যন্ত্রনা হয়েছে মটর সাইকেলের অত্যাচার। ট্রাফিক আইন লংঘন হচ্ছে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সামনেই। তারা বিভিন্ন মোটরযান হরদম থামিয়ে জরিমানা করছে - তবে তা শুধু নিজেদের স্বার্থে, ডিউটি পালন করতে নয়। তেজগাঁও সাত রাস্তার মোড় আবার ট্রাকের দখলে। আনিসুল হক যদি অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে পারেন, তাহলে বর্তমান প্রশাসন পারছে না কেন! আনিসুল হক দেখিয়েছেন যে সদিচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব। মিরপুরে দেখলাম যে তিন লেন করে মোট ছয় লেনের রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম। দুই পাশের ফুটপাতসহ রাস্তার এক লেইন পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের দখলে। রিকশা, সিএনজি আর ভ্যান গাড়ির পার্কিং হয়েছে দ্বিতীয় লেনে। মাত্র এক লেন দিয়ে সব যানবাহন চলাচল করছে। নিয়ম-নীতির থোড়াই কেয়ার করে গোঁদের উপড় বিষফোঁড়ার মতো আছে উল্টা পথে যানবাহন চলাচল। এই বিষয়ে মটোকপ নামে এক সচেতন নাগরিক সব সময় লাইভ পোস্ট দেয়। আইন ভংগকারীরা এটাকে কোন অন্যায়ই মনে করে না। দেখা যায় যে যার ক্ষমতা যতো বেশী সে তত বেশী আইন ভংগ করছে। সমস্ত ঢাকা জুড়ে একই চিত্র।
ছোটবেলায় কমলাপুরে দেখেছি কাক ডাকা ভোরে সিটি কর্পোরেশনের সুইপাররা মহল্লার রাস্তা ঝাড়ু দিতো। আমরা সকালে উঠে সব রাস্তা ঝকঝকে দেখতাম। কলেজে যাওয়ার পথে তাদেরকে দেখতাম যে কাজ শেষে রাস্তার ধারে বসে ডালপুরি আর চা দিয়ে নাশতা করছে। স্যানিটেশন ইন্সপেকটর নিয়মিত এসে কাজের তদারকি করতো। এখন কোথাও আগের মতো সুইপারদের কোন কর্ম-কান্ড চোখে পড়েনি। ঢাকা শহরের প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি অলি-গলি ধূলায় ধূসরিত। যান-বাহন থেকে নির্গত কার্বনের সাথে ধূলা-বালি মিশে পরিবেশের এক ভয়ংকর অবস্থা। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে গাছগুলির করুন অবস্থা দেখে। প্রতিটি পাতার উপড় ধুলার পুরু আস্তর পড়ে আছে। আমার স্ত্রী বাইরে গেলেই গাছগুলির জীর্ন অবস্থা দেখে আফসোস করতো। একদিন মুষলধারে বৃষ্টিপাতের পর সব গাছ যেন পুনরায় জীবন ফিরে পেয়েছিলো। ছোটবেলায় দেখতাম মিউনিসিপালটির গাড়ি নিয়মিত প্রধান সড়কের আইল্যান্ডের গাছগুলিতে পানি ছিটাতো। অধিকাংশ রাস্তার ফুটপাত ব্যবসায়ীদের দখলে। নিকেতনের পাশে ফুটপাত দখল করে রাজনৈতিক দলের অফিস করা হয়েছে। এবার দেখলাম সেখানে বিল্ডিং করা হয়েছে। বিভিন্ন বাড়ির সামনে ফুটপাত কেটে ড্রাইভওয়ে করা হয়েছে। ড্রাইভওয়ের স্লোপের কারনে অসমতল ফুটপাত দিয়ে হাঁটা অনিরাপদ। ড্রাইভওয়ের ব্যাপারে রাজউকের নির্দিষ্ট কোন নীতিমালা আছে কিনা জানা নেই।
দেশ থেকে ফিরে গত বছর আমার এক লেখায় দূর্নীতি প্রসঙ্গে বলেছিলাম যে আমাদের দেশে এটা বন্ধ করা যাবে না। তবে দূর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারলে দেশটার আরও উন্নতি হতো। এবার ব্যাক্তিগত কিছু কাজে বিভিন্ন সরকারি অফিসে যেতে হয়েছিলো। সব অফিসের সব ডেস্কে মানুষের ভীড়। তবে তাদের বেশীর ভাগই দালাল। তাদের সাথে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের খুবই সুন্দর সম্পর্ক। সব কাজ তাদের মাধ্যমে করতে হয়। একটা সামান্য কাজের জন্য দিনের পর দিন অপচয় হয়। সব জায়গায় খোলাখুলি ঘুষের লেনদেন। লজ্জা-শরম, নীতি-আদর্শ বা সততা শব্দগুলি আতসী কাচঁ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। যাঁদের ঘুষ দেয়ার ক্ষমতা বা উপড়ের কানেকশন নেই তারা শুধু দিনের পর দিন সরকারি দপ্তরের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার যে এইসব দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা/কর্মচারিরা জোহরের নামাজের ওয়াক্তে অফিসের ভিতরেই বিরাট আয়োজন করে জামাতে নামাজ পড়ে।
গত রমজানে আমার এক ক্লায়েন্ট বললো যে এক অফিসের কর্মকর্তার ডেস্কের পাশে একটা ব্যাগ রাখা আছে। রোজা রেখেছে বলে সেই কর্মকর্তা ঘুষের টাকা হাতে নিবেন না - ব্যাগে রাখতে হয়। দিনের শেষে কষ্টার্জিত ঘুষের টাকা ভর্তি ব্যাগটা নিয়ে উনি বাসায় ফিরেন। ভন্ডামি কাহাকে বলে, কতো প্রকার ও কি কি - তার বাস্তব উদাহরন এইসব সরকারি কর্মচারিরা। ইসলামে নির্দেশ আছে যে ঘুষ নেয়া হারাম। একবার হারাম রুজির খাবার খেলে চল্লিশ দিন পর্যন্ত শরীর নাপাক থাকে। আর নাপাক শরীরে কোন ইবাদত হয় না।